খালেদা জিয়া আজীবন সংগ্রামী, গণতন্ত্রের জননী
বগুড়ার সোনাতলার হুয়াকুয়া গ্রামের আবুল হোসেন (ছদ্মনাম)। জীবনের ৫৫ বছর কেটে গেছে। শৈশব থেকে শুরু করে যৌবনের দিনগুলোতে ভোটকেন্দ্রে আনন্দ উল্লাস করে। কিন্তু এই ঘটনায় ছেদ পড়ে আওয়ামী লীগের হাতে নির্বাচনী কাঠামো যাওয়ার পর। এরপর এক ভোট কেন্দ্রে গিয়ে শুনলেন, তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে চলে গেছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের একতরফা ভোটের ফলাফলে শুনলেন মৃত ব্যক্তিও নাকি শেখ হাসিনাকে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছেন। দুনিয়ায় এমন ঘটনা বিরল হলেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এটি ঘটিয়ে বীরদর্পে মানুষের গণতন্ত্রের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনার হাত থেকে গণতন্ত্র পুররুদ্ধারের জন্য নানান নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলন করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি গতকাল ভোরে দেশের কোটি কোটি ভক্ত, সমর্থকদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়ার বাবার নাম ইস্কান্দার মজুমদার। বাড়ি ফেনী জেলার পরশুরামের শ্রীপুর গ্রামে। মা তৈয়বা বেগমের জন্ম পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়িতে। তাদের তিন কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল খালেদা খানম। দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন বলে বাড়ির লোকেরা তাকে পুতুল বলে ডাকতেন। সেটিই তার ডাকনাম হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে। পরে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চমাধ্যমিক) উত্তীর্ণ হন। সেনাবাহিনীর তরুণ ও চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের বালুবাড়িতে পৈতৃক বাড়িতে খালেদা খানমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তাকে সবাই খালেদা জিয়া নামে চেনেন, যিনি গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী।
খালেদা জিয়ার জীবন নানান কারণে বর্ণাঢ্যময়। তিনি একজন রাজনৈতিক নেত্রী। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক দীর্ঘ, রক্তাক্ত, কণ্টকাকীর্ণ পথের জীবন্ত প্রতীক। তার জীবনের অধ্যায়জুড়ে ছিল ক্ষমতা ও কারাগার, বিজয়, পরাজয়, আপসহীনতা, নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা ও ঘৃণা। ইতিহাসের নিষ্ঠুর সত্য হলো, শুধু জীবিত নয়; মৃত্যুর পর তিনি উঠেছেন সময়ের দলিল। খালেদা জিয়া আজ সেই দলিল, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের লড়াইয়ের এক অনিবার্য নাম।
খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসা কোনো পরিকল্পিত উচ্চাকাক্সক্ষার ফল ছিল না। তিনি রাজনীতির পরিবারে জন্মাননি, ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেননি। গৃহবধূ হিসেবে তার জীবন ছিল নীরব, ঘরকেন্দ্রিক। কিন্তু ইতিহাস অনেক সময় ব্যক্তির প্রস্তুতির অপেক্ষা করে না; বরং সময় নিজেই মানুষকে প্রস্তুত করে নেয়।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর, এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতা ও জাতীয় শোকের আবহে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক আবির্ভাব। এটি ছিল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকে জাতীয় দায়িত্বে উত্তরণের এক বিরল দৃষ্টান্ত। স্বামীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করলেও তিনি কখনো কেবল ‘জিয়ার স্ত্রী’ হয়ে থাকেননি; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়, কণ্ঠস্বর ও দৃঢ়তা গড়ে তুলেছেন।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা তাকে গণতন্ত্রের জননী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি যে সাহসিকতা ও অনমনীয় অবস্থান দেখিয়েছেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য। রাজপথে নামা, গ্রেপ্তার হওয়া, হুমকি ও দমন,পীড়নের মুখেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, এই অভিজ্ঞতা তাকে কেবল একজন দলনেত্রী নয়, বরং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত করে।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার দরজা খুলেছিল, তার পেছনে খালেদা জিয়ার অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ক্ষমতায় থাকার সময় তার শাসনকাল নিয়ে সমালোচনা আছে। এটি থাকারও কথা। এটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু একটি সত্য অস্বীকার করা যায় না; তিনি কখনো নির্বাচনের প্রশ্নে আপস করেননি।
১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী পদক্ষেপগুলোর একটি। ক্ষমতা আঁকড়ে না ধরে গণতান্ত্রিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত। এই সিদ্ধান্ত তাকে শুধু বিএনপির নেত্রী নয়, গণতন্ত্রের পক্ষের নেত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা দিয়েছে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল দ্বন্দ্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বৈরিতার দীর্ঘ অধ্যায়ে তিনি ছিলেন এক প্রধান চরিত্র। এই দ্বন্দ্ব অনেক সময় রাজনীতিকে অচল করেছে, সমাজকে বিভক্ত করেছে; এ দায় পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার। তবুও খালেদা জিয়া কখনো তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার পথে যাননি। কঠোর ভাষা, তীব্র আন্দোলন সবকিছুর মধ্যেও তিনি বহুদলীয় রাজনীতির কাঠামোকে অস্বীকার করেননি। সংসদীয় রাজনীতি, নির্বাচন, বিরোধী দল এই ধারণাগুলোর অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেছেন, যা স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার বিপরীত।
ক্ষমতার বাইরে তার সংগ্রাম ছিল আরও কঠিন। দীর্ঘ সময় ধরে মামলা, গ্রেপ্তার, কারাবাস, অসুস্থতা, সব মিলিয়ে তার শেষ জীবনের বড় অংশ কেটেছে রাষ্ট্রীয় দমননীতির মুখে। বারবার আদালতে হাজিরা, চিকিৎসার জন্য সংগ্রাম, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বাধা এসবের মধ্যেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি। অসুস্থ শরীর নিয়ে নীরব থেকেও তিনি ছিলেন প্রতীকী প্রতিবাদ। তার নীরবতাই অনেক সময় হয়ে উঠেছে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাষা।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর নেতৃত্বের প্রশ্নে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ঐতিহাসিক। তিনি শুধু একজন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না; তিনি প্রমাণ করেছিলেন, এই সমাজে নারী নেতৃত্ব প্রভাবশালী ও অত্যন্ত কার্যকর। সামাজিকভাবে রক্ষণশীল এক বাস্তবতায় তিনি রাজনীতি করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লড়াই করেছেন। তার পথ ধরে অসংখ্য নারী রাজনীতিতে এসেছেন, কেউ তার অনুসারী, কেউ সমালোচক, কিন্তু অনুপ্রেরণা হিসেবে খালেদা জিয়ার নাম অস্বীকার করা যায় না।
সমালোচকেরা বলেন, তিনি দলীয় রাজনীতিতে আপসহীন ছিলেন, কখনো কখনো সংকীর্ণও। এই সমালোচনা পুরোপুরি অমূলক নয়। কিন্তু রাজনীতিতে আপসহীনতা কখনো দুর্বলতা, কখনো শক্তি, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এই আপসহীনতাই তাকে দীর্ঘদিন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। তিনি জানতেন, আপস মানে অনেক সময় আদর্শ বিসর্জন। সেই আদর্শের মূল্য তাকে দিতে হয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে, শারীরিক অসুস্থতায়, নিঃসঙ্গতায়।
খালেদা জিয়ার জীবন আমাদের শেখায়, গণতন্ত্র কখনো উপহার হিসেবে আসে না; এটি অর্জন করতে হয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই ছিল লড়াই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার লোভের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে। তিনি কখনো গণতন্ত্রের প্রশ্নে আত্মসমর্পণ করেননি। এই কারণেই তিনি ‘গণতন্ত্রের জননী’।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর দেশ থেকে স্বৈরাচারের বিদায় হয়েছে। খালেদা জিয়া তার সর্বোচ্চ দিয়ে হাসিনাবিরোধী অবস্থানে অটল ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক দেশের প্রসিদ্ধ এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘শারীরিকভাবে বিদায় নিলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র হিসেবে, বিশেষ করে জেনারেল এরশাদের আমলে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তাঁর লড়াকু ভূমিকার জন্য খালেদা জিয়া স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
ঠিক একইভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বগুড়ার সোনাতলার হুয়াকুয়া গ্রামের আবুল হোসেনের জীবনেও। কারণ দীর্ঘদিন পরে আবার গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছে দেশ; যেখানে আবেদ আলী তার হারানো দিনগুলিতে ফিরতে পারবেন।
আমরা আশা করি, দেশ তার ঠিকানায় পৌঁছাবে। সব ঠিক থাকলে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। ব্যাপক সম্ভাবনাময় তারুণ্য নির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে দেশের আগামীর গতিপথ নির্ধারণ হবে। এটিও খালেদা জিয়ার মরণোত্তর সম্মাননা।
লেখক :
কালাম আজাদ
সাধারণ সম্পাদক, বগুড়া প্রেসক্লাব
সমন্বয়কারী, বিএনপি মিডিয়া সেল
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








