অবৈধ ভারতীয় শ্রমিকের দাপট
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে শ্রমবাজারে একটি গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, যা বর্তমানে পুরো দেশের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকটটি শুধু শ্রমজীবী মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে না, বরং এটি দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গভীর প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যার মূল কারণ হলো- ভারতীয় নাগরিকদের অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ ও শ্রমবাজারে তাদের ব্যাপক উপস্থিতি। অবৈধ অনুপ্রবেশের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, এখন এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র এবং হুন্ডি সিন্ডিকেটের সাথে সম্পর্কিত হয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য একটি মারাত্মক সংকেত হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় শ্রমিকদের অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসা শুরু হয়েছে গার্মেন্টস, নির্মাণ শিল্প, কৃষি কাজ, কনসালটেন্সি, সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং অন্যান্য নিম্নমানের খাতে, যেখানে তারা কখনো স্বল্প মজুরিতে আবার কোনো কোনো খাতে বেশি পারিশ্রমিকে কাজ নিয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করছে, ফলে দেশের শ্রমবাজারের স্বাভাবিক ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশে অবৈধভাবে ভারতীয় শ্রমিকদের প্রবেশ ধীরে ধীরে আরও বিস্তৃত হয়ে উঠছে এবং তারা শ্রমবাজারের বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের দখল জমাতে শুরু করেছে। বিশেষত, গার্মেন্টস, নির্মাণ শিল্প, কনসালটেন্সি, সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে তাদের উপস্থিতি এখন আরও বেশি লক্ষণীয়। অনেক বাংলাদেশি কোম্পানির ধারণা, ভারতীয় শ্রমিকরা তাদের তুলনায় বেশি দক্ষ, বিশেষত কিছু ক্ষেত্রে তাদের কাজের গুণগত মান ও পেশাদারিত্ব স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় ভালো হতে পারে বলে মনে করা হয়। এই কারণে, কোম্পানিগুলি ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য চাকরি হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে, ভারতীয় শ্রমিকদের কাজের শর্ত বা সুবিধাও স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে উন্নত হতে পারে, যার ফলে শ্রমবাজারে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান সংকট তৈরি হচ্ছে।
বিশেষভাবে কনসালটেন্সি, আইটি এবং সফটওয়্যার খাতে ভারতীয়দের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার থাকা সত্ত্বেও, ভারতীয় জনবল লাখ লাখ সংখ্যায় বাংলাদেশে কাজ করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন এবং তাদের অধিকাংশেরই কোনো ওয়ার্ক পারমিট নেই। ভারতীয়রা শুধু কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বেতন স্থানীয়দের তুলনায় অনেক বেশি। এভাবে তারা বাংলাদেশে কাজ করে, এবং তাদের আয়ের অধিকাংশ অর্থই অবৈধ পথে ভারত পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম খাতে ভারতীয়দের দাপট বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। বিভিন্ন কোম্পানিতে দেখা যায়, ভারতীয় শ্রমিকরা এমনভাবে নিজেদের কাজের কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে, প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে আরও ভারতীয় জনবল নিয়োগ করতে হয়। অনেক সময় তারা শর্ত দেয় যে, “আমাদের লোক নিলে তবেই কাজ হবে”, ফলে কোম্পানিগুলো তাদের দেশের কর্মী নিয়োগে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
এমনকি তাদের রোজগারের পুরো অর্থ হুন্ডি এবং অবৈধ অর্থ পাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বের হয়ে যায়। এই চক্রটি এতটাই শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত যে, এর মাধ্যমে প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকা বৈধ পথে না গিয়ে অবৈধ পথে ভারতে পাচার হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নীরবভাবে বড় ক্ষতি করে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, প্রতি বছর ভারতীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে এবং স্থানীয় অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা, যা সাম্প্রতিক সময়ে আরও মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বিশেষত, সীমান্তে দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু বিজিবি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ভারতীয় নাগরিকরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। সীমান্তে অবৈধ প্রবেশপথ দিয়ে প্রতিদিন অনেক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব অবৈধ প্রবেশ পথের ব্যবহার করার জন্য ভারতীয় নাগরিকরা বিভিন্ন ধরনের শরণার্থী এবং শ্রমিক পরিচয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এ কারণে সীমান্তে নজরদারি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে, এবং কঠোর নিরাপত্তা প্রোটোকল চালু করতে হবে। যদিও বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট আইন, ১৯২০ এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী স্পষ্টভাবে বৈধ ওয়ার্ক পারমিট ও নিয়োগপত্র ছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিককে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার নিয়ম নেই, তারপরও এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর রয়ে গেছে। পাসপোর্ট আইন অনুসারে বৈধ ভিসা ও অনুমতি ছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিকের বাংলাদেশে প্রবেশ ও কাজ করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ শ্রমবাজারে বৈধ নিয়োগপত্র ও চুক্তির বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করেছে, যা স্থানীয় ও বিদেশি উভয় শ্রমিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে বিদেশি শ্রমিকরা বছরের পর বছর ভিসার শর্ত ভেঙে থেকে যাচ্ছে এবং শ্রমবাজারের ভারসাম্য নষ্ট করছে।
আরও পড়ুনএই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি ব্যবস্থাকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিটি সীমান্ত চৌকিতে বায়োমেট্রিক চেকপোস্ট, স্মার্ট নজরদারি ক্যামেরা ও ড্রোন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। সীমান্তে বিজিবির কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আর কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে না পারে। সেইসাথে যেসব প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ করছে, তাদের তালিকা তৈরি করে নজরদারি বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থপাচার রোধে হুন্ডি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একযোগে এনবিআর, বিএফআইইউ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলকে আরও সহজ ও আকর্ষণীয় করতে হবে, যাতে বিদেশি মুদ্রা বৈধ পথে দেশে আসে। একইসাথে স্থানীয় শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারকে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। এতে স্থানীয় জনশক্তি কাজে লাগবে এবং বিদেশি শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীলতা কমবে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ভারতীয় নাগরিকদের অবৈধ প্রবেশ এবং তাদের দখলদারিত্ব শুধু দেশের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় শ্রমিকদের অবৈধ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা, তাদের কর্মসংস্থান ও অপরাধমূলক কার্যক্রমের ওপর নজর রাখা, এবং সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এখন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে, বাংলাদেশের শ্রমবাজার এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে।
লেখক
নুর হোসেন নয়ন
শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রংপুর।
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








