বাকস্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ নাকি অন্যকিছু
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জনমনে এক উচ্ছ্বসিত হৃদয় জন্ম নিয়েছিল। লাখো মানুষ নতুন করে স্বাধীনভাবে বাঁচবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তারা ভেবেছিল কিভাবে তাদের প্রতি ঘটে আসা প্রতিটি অন্যায়-অবিচার প্রকাশ করবে, কিভাবে তারা তাদের ন্যায্য অধিকারগুলো নির্দ্বিধায় নিজেদের বসানো সরকারের কাছে তুলে ধরবে। দীর্ঘ সময়ের দমন-পীড়নের পর অবশেষে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তারা তাদের দাবি-দাওয়া প্রকাশের সুযোগ পাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সেই সময় সাধারণ মানুষের এই আবদার শুনতে ও বুঝতে আন্দোলনের সুযোগ প্রদান করেন। বলা যায়, আন্দোলন এমন একটি শব্দ যা বিগত সতেরো বছর ধরে আমরা কেবল শুনে এসেছি, দেখে এসেছি। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বাকস্বাধীনতা চর্চার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও শেষ ষোল বছর অনেক মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে এই ন্যূনতম অধিকার চর্চা করতে পারেনি। বর্তমানে মানুষ আবারও নির্দ্বিধায় সেই অধিকার চর্চা করতে পারছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা কি এতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ভোগ করতে পারছে? উত্তর সহজ অবশ্যই না।
কারণ আন্দোলনের ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও। যেমন প্রতিনিয়ত আন্দোলনের কারণে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চোখে আমাদের দেশ অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে, যার ফলে ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কমছে। উপরন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তীকালীন, তাদের সময় সীমিত। তারা চাইলে ধৈর্যসহকারে শুনে যৌক্তিক সমাধান করতে পারে না; কারণ সরকারের কার্য মেয়াদ শেষ হয়ে আসবে তার আগেই।
ফলাফল হলো এই অব্যাহত আন্দোলনের স্রোত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি, নাজুক সামাজিক পরিস্থিতি এবং বিধ্বস্ত বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর গভীর ও জটিল প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত আমাদের দেশকে অস্থিতিশীল হিসেবে প্রচার করছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর। বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা কর্মসংস্থানের জন্য গমন করা অনেকের ভিসা বাতিল হচ্ছে, যেন এটি এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশিদের মান কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও হতাশার।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে তাহলে কি সব আন্দোলন অযৌক্তিক ছিল? অবশ্যই না। কারণ ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের আগেও অনেক মানুষ তাঁদের যৌক্তিক দাবির জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের সেই আন্দোলনগুলোও ছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। মানুষ ভেবেছিল, সরকার হয়তোবা তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলো পূরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে সরকার কতটুকুই বা পেরেছে?
যেমন আমি শুরুতেই বলেছি, সরকারের সময় খুবই সীমিত। তাদের প্রধান কাজ হলো—অভ্যন্তরীণ সমস্যা কিছুটা সমাধান করে দেশের অর্থনীতি পুনরায় সচল করা, যৌক্তিক সংস্কার কার্যকর করা এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করা। সতেরো বছর পর গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের এই উদ্যোগ এক বিশাল দায়িত্ব। অল্প সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষে গভীরে গিয়ে দীর্ঘ আলোচনা-সমালোচনা করে সব দাবি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই এ পরিস্থিতিতে যারা আন্দোলন করছেন, তাঁদের উচিত নিজেদের যৌক্তিক দাবিগুলো প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানানো। যাতে করে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা নথিভুক্ত করে রেখে যায় এবং পরবর্তী সরকার নির্বাচিত হলে সেই দাবিগুলো মেনে নিয়ে জনমানবের দাবি পুরণ করে। আন্দোলনের মাধ্যমে কেবল জনজীবনে ভোগান্তি সৃষ্টি নয়, বরং একটি গঠনমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাবি তোলা উচিত।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ সময় পর আন্দোলনের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। এই স্বাধীনতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে একইসাথে প্রয়োজন দায়িত্বশীল আচরণ, যাতে দেশের অর্থনীতি, কূটনীতি কিংবা সাধারণ নাগরিকজীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে সব যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করবে প্রকৃত অর্থেই “জনমানুষের সরকার”।
লেখক
আফিফা জাহান পুষ্প
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








