পঙ্গুত্ব জয় করে সফল উদ্যোক্তা বগুড়ার নন্দীগ্রামের সত্যেন
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি : পথ চলা তার কঠিন ছিল, কিন্তু থেমে থাকেননি কখনও। শৈশবে পোলিও আক্রান্ত হয়ে দুটি পা অকেজো হয়ে যাওয়ার পরও জীবনের কাছে হার মানেননি বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটগ্রাম ইউনিয়নের কাথম গ্রামের দ্বিজেন্দ্র নাথের ছেলে সত্যেন কুমার সরকার (৩৭)।
নিজের ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসই তাকে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে সাহায্য করেছে। আজ তিনি এলাকার পরিচিত ফটোগ্রাফার, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিভা এবং আপন ডিজিটাল স্টুডিও অ্যান্ড ভিডিও’র সফল উদ্যোক্তা।
১৯৮৮ সালে জন্ম নেওয়া সত্যেন মাত্র চার বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হন। কয়েক মাসের ব্যবধানে ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ে তার দুই পা। বাবা-মা ডাক্তার, কবিরাজ যেখানে যেতে বলা হয়েছে সেখানেই ছুটেছেন কিন্তু কোনো চিকিৎসাই তাকে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি। পঙ্গুত্ব তাকে ঘিরে ধরলেও বাবা-মা তাকে বোঝা হতে দেননি।
ভর্তি করিয়ে দেন গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সত্যেনও তার জীবনে প্রতিবন্ধকতাকে সবচেয়ে বড় শক্তিতে রূপান্তর করেন। সহপাঠীদের সহায়তা, শিক্ষকদের উৎসাহ আর নিজের দৃঢ় মনোবল তাকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যায়। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শুরু করে ২০০৬ সালে এসএসসি, ২০১০ সালে এইচএসসি এবং ২০১৩ সালে বিএ পাস করেন তিনি। ২০১৫ সালে সম্পন্ন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি একটি নতুন আগ্রহ জন্ম নেয় ফটোগ্রাফি। ক্যামেরা হাতে নিলেই তার মনে হতো জীবনের নতুন এক দরজা খুলে যায়। তাই ফটোগ্রাফিতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন সত্যেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধি কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে প্যারালিম্পিক গেমসে ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৫৭টি দেশের প্রতিযোগীর মধ্যে ৫ম স্থান অর্জন করেন যা তার জীবনের অন্যতম বড় সাফল্য।
চাকরি না পেয়ে তিনি নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নন্দীগ্রাম পৌর এলাকার পোস্ট অফিস সংলগ্ন একটি মার্কেটে প্রতিষ্ঠা করেন আপন ডিজিটাল স্টুডিও অ্যান্ড ভিডিও। শুরুতে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল অল্প সরঞ্জাম, ছোট জায়গা, সীমিত সঞ্চয়। কিন্তু আজ তার স্টুডিওতে নিয়মিত ভালো কাজ হচ্ছে।
বিয়েসহ বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানের ফটোগ্রাফি, ভিডিও শুট, পাসপোর্ট সাইজ ছবি সব মিলিয়ে ব্যবসা এখন বেশ পরিচিতি পেয়েছে। স্টুডিওর পরিসর বড় না হলেও তার পরিশ্রম, সময় নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার কারণে গ্রাহকেরা সন্তুষ্ট থাকেন। প্রতিদিন সকালে নিজে স্কুটি চালিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে দোকান খোলেন। দোকানে আসার আগে ছেলেকে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেন। স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোন নিয়ে তিনি এখন সুখি পরিবার জীবন কাটাচ্ছেন।
সত্যেন বলেন, ভবিষ্যতে বড় একটি আধুনিক স্টুডিও করতে চাই। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী তরুণদের জন্য ফটোগ্রাফি শেখানোর ব্যবস্থা করতে চাই, যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধীদের অবহেলা করবেন না। আমরা মানুষÑআমরাও পারি। শুধু একটু সহানুভূতি আর সুযোগ দিন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, সত্যেন সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। আমরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি। তার মতো পরিশ্রমী প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর সবসময় প্রস্তুত।
নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম বলেন, সত্যেনের গল্পটি সত্যিকার অর্থে অনুপ্রেরণাদায়ক। সত্যেন অসাধারণ মানসিক শক্তির অধিকারী। তিনি নিজের চেষ্টা ও অদম্য মনোবলে যে জায়গায় পৌঁছেছেন তা প্রশংসনীয়। তার মতো মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের দায়িত্ব। উপজেলা প্রশাসন তার মতো উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
মন্তব্য করুন






