যীশু খ্রিস্টের জীবনদর্শন: অস্থির পৃথিবীতে শান্তির আলোকবর্তিকা
শীতের সকালের নরম রোদের মতো এক শান্তির বার্তা নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে বড়দিন। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন যিশু খ্রিস্ট। তাঁর জন্ম কোনো বড় প্রাসাদে হয়নি, হয়েছিল এক অতি সাধারণ গোয়ালঘরে। এই সাধারণ শুরুটাই আমাদের বড় এক শিক্ষা দেয় আর তা হলো বিনয়। আজ যখন আমরা আধুনিক যুগের বড় বড় অট্টালিকায় বাস করি, তখন যিশুর সেই গোয়ালঘরের জন্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষের বড়ত্ব তার ধন-সম্পদে নয়, বরং তার সরলতায়।
যিশুর বেড়ে ওঠা ছিল আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। তিনি ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রির ছেলে। নিজের হাতে কাজ করতেন, ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করতেন। গ্রামের সহজ-সরল মেহনতি মানুষের দুঃখ-কষ্ট তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। বড় হয়ে তিনি যখন মানুষের কল্যাণে কাজ শুরু করলেন, তখন তাঁর পরিচয় হলো মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে। তিনি সেই সময়কার সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ মানতেন না। তিনি কুষ্ঠরোগীকে নিজের হাতে সেবা করেছেন, অন্ধের চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং যারা সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের বুকে টেনে নিয়েছেন। তাঁর কাছে ধর্ম মানেই ছিল মানুষের সেবা করা।যিশুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল ভালোবাসা। তিনি এমন এক সময়ে এসেছিলেন যখন মানুষে মানুষে প্রচুর ঘৃণা আর হিংসা ছিল। তিনি এসে আমাদের শিখিয়ে দিলেন এক অদ্ভুত মন্ত্র। তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের শত্রুকেও ভালোবাসো এবং যারা তোমাদের ঘৃণা করে তাদের জন্য ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করো।” এই কথাটা শুনতে খুব সহজ মনে হলেও মেনে চলা অনেক কঠিন। কিন্তু যিশু বিশ্বাস করতেন, গালমন্দ বা মারামারি দিয়ে কখনো অশান্তি দূর করা যায় না। কেবল ভালোবাসা আর ক্ষমাই পারে মানুষের মন জয় করতে। আজকের এই যুগেও যখন আমরা সামান্য জমিজমা বা তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে একে অপরের সাথে বিবাদে লিপ্ত হই, তখন যিশুর এই কথাটি আমাদের শান্তির পথ দেখায়।
যিশু খ্রিস্টের জীবনে একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে। একবার এক পাপিষ্ঠ নারীকে সমাজ পাথর ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল। তখন যিশু ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন, “তোমাদের মধ্যে যে মানুষটি জীবনে কোনোদিন কোনো ভুল বা পাপ করেনি, সে-ই প্রথম পাথরটি ছুঁড়ুক।” এই কথা শোনার পর দেখা গেল, সবাই লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল। এই ঘটনাটি আমাদের শেখায় যে, আমরা নিজেরা কতটুকু ভালো তা না দেখে অন্যের বিচার করা ঠিক নয়। গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে শহরের আদালত সর্বত্রই যদি আমরা অন্যের বিচার করার আগে নিজেদের একটু শুধরে নিতাম, তবে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতো। যিশুর প্রস্থান বা তাঁর মৃত্যু ছিল ত্যাগের এক বিরাট উদাহরণ। তাঁকে যখন বিনা অপরাধে কষ্ট দেওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি তাঁর শত্রুদের অভিশাপ দেননি। বরং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে প্রার্থনা করেছিলেন, “হে ঈশ্বর, এদের তুমি ক্ষমা করে দাও, কারণ এরা জানে না যে এরা কী করছে।” শত্রুতাকে এভাবে জয় করার উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও নেই। তাঁর এই আত্মদান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও সত্য এবং ন্যায়ের পথে টিকে থাকা উচিত। বর্তমানের লোভী পৃথিবীতে যখন আমরা কেবল নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত, তখন যিশুর এই ত্যাগের আদর্শ আমাদের মানুষ হিসেবে বাঁচতে শেখায়। আজকের এই বড়দিনে আমাদের বড় কাজ হলো নিজেদের মনটাকে পরিষ্কার করা। যিশু বলতেন, মানুষের ভেতর থেকে যা বের হয় (যেমন-খারাপ কথা, হিংসা বা মিথ্যা), তা-ই মানুষকে অপবিত্র করে। তাই কেবল নতুন জামাকাপড় পরা বা ঘর সাজানোই বড়দিন নয়। বড়দিনের আসল সার্থকতা হলো পাশের অভাবী মানুষটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আপনি যদি আপনার প্রতিবেশী কোনো ক্ষুধার্ত মানুষকে এক মুঠো অন্ন দেন বা কোনো দুঃখী মানুষের চোখের জল মোছান, তবেই যিশুর প্রতি আপনার আসল সম্মান জানানো হবে। যিশু কোনো নির্দিষ্ট দলের বা গোষ্ঠীর নন, তিনি পুরো দুনিয়ার মানুষের জন্য এক আলোর দিশারি। তাঁর শিক্ষা আমাদের শেখায় হাতে হাত রেখে মিলেমিশে থাকা। আজকের এই অশান্ত পৃথিবীতে যখন দেশে দেশে যুদ্ধ চলছে, তখন যিশুর সেই শান্তির বাণী সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমাদের গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত প্রতিটি ঘরে যদি এই ভালোবাসার আলো জ্বলে ওঠে, তবেই দূর হবে সব অন্ধকার। আসুন, আমরা শপথ নিই হিংসা নয়, ভালোবাসাই হবে আমাদের জীবনের চলার পথ। মানুষের সেবা করাই হোক আমাদের পরম ধর্ম। বড়দিনের এই পবিত্র আনন্দ প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে সুখ আর শান্তি বয়ে আনুক।
লেখক
আরও পড়ুনসুমন পাল
প্রাবন্ধিক
সলংগা, সিরাজগঞ্জ।
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








