ব্যাংকগুলোতে কমছে নারী কর্মী

নিজের আলোয় ডেস্ক : একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সমগ্র ব্যাংক খাত ছিল মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রথম পছন্দ। বিসিএস বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার মতো প্রতিযোগিতামূলক চাকরি ছেড়েও অনেকে যোগ দিতেন ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে। কারণ ছিল সম্মানজনক সুযোগ-সুবিধা, বাসা ও গাড়ির জন্য সহজ ঋণ সুবিধা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা। তবে বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়োগে অনিয়ম, সুযোগ-সুবিধা সংকোচন এবং সামগ্রিক অনিশ্চয়তার কারণে এখন ব্যাংক খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক মেধাবী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৩ হাজার ২৬৭। মাত্র ছয় মাস আগেও এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ২৪৫। অর্থাৎ অর্ধবছরে কমেছে ৯৭৮ জন কর্মী। এর মধ্যে নারী কর্মী কমেছে এক হাজার ৮৬৭ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি ও অনিয়মে জর্জরিত হয়ে পড়া ব্যাংক খাতে অনিশ্চয়তা এখন এতটাই বেড়েছে যে চাকরির বাজারে ব্যাংকিং ক্যারিয়ার আর আকর্ষণীয় থাকছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিতে আসার একটি বড় কারণ ছিল নিজস্বতা। স্বাধীনভাবে তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। এখন পরিদর্শনসহ বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে হতাশা রয়েছে। আবার অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সুযোগ-সুবিধাও কিছুটা বেশি পেতেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ধীরে ধীরে তা কমিয়ে অন্য চাকরির মতোই করা হচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, কোনো ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ পাওয়া অনেককে ছাঁটাই করছে বিভিন্ন ব্যাংক। তবে সে হারে নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। এতে ব্যাংক খাতে কর্মীর সংখ্যা কমেছে। বেশি কমেছে নারী কর্মী। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত জুনভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংক খাতে গত জুন শেষে নারী কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৭৮২ জন, যা মোট কর্মীর ১৬.৭৮ শতাংশ। ছয় মাস আগে যেখানে নারী কর্মী ছিলেন ৩৭ হাজার ৬৪৯ জন, যা মোট কর্মীর ১৭.৫৭ শতাংশ। এর মানে ছয় মাস আগের তুলনায় নারী কর্মী কমেছে এক হাজার ৮৬৭ জন। একই সময় পুরুষ কর্মীর সংখ্যা ৮৮৯ জন বেড়ে এক লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৬ জনে ঠেকেছে, ছয় মাস আগে যা ছিল এক লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ জন। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতে ব্যাপক ছাঁটাই আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরই মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। পাওয়া তথ্য মতে, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে মোট দুই হাজার ২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু আল-আরাফাহ ব্যাংক থেকেই ৫৫০ জন কর্মকর্তা চাকরি হারান। তবে মাত্র চার ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মীদের চেয়ে মোট চাকরিচ্যুতির সংখ্যা কম হওয়ার কারণ নতুন নিয়োগ।
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, গত এক বছরে তাদের ব্যাংক থেকে ৫৪৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মই এর প্রধান কারণ। চাকরিচ্যুতদের প্রায় ১০ শতাংশ নারী। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন সরকার আসার পর যেসব ব্যাংক একক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব ব্যাংক থেকে অনেক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। একই সঙ্গে অনিশ্চয়তার কারণে অনেক কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন। অনিশ্চয়তা থাকায় নারীরা ব্যাংক খাত থেকে অন্য খাতে চলে যাচ্ছেন। পাশাপাশি গত ছয় মাসে নতুন নিয়োগেও নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের পরিচালক চৌধুরী লিয়াকত আলী জানান, গত ছয় মাসে বেশ কিছু ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ধরা পড়েছে। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, একই সময় নতুন নিয়োগও কম হয়েছে।
আরও পড়ুনবাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংকগুলোতে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, যাতায়াত সুবিধা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর আগের ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অবনতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে অফিস সময়ের পর নারীদের যাতায়াত সুবিধার। গত বছরের শেষ ছয় মাসে ব্যাংকগুলোতে ৫২ শতাংশ নারী এই সুবিধা পেতেন। গত ছয় মাসে তা কমে ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
ব্যাংক খাতে নারী কর্মী কমে যাওয়া ও নারীদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রারম্ভিক পর্যায়ের এক নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘নারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছয় মাসের ছুটিকে কর্মমূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। কাজের মূল্যায়ন, ডে কেয়ার ও যাতায়াত সুবিধায় নারীদের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্য রয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার পর নারী কর্মীদের অফিস ছাড়তে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও তা বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মানে না। গত পাঁচ বছরে সন্তান পরিপালনের অসুবিধার কারণে আমার পরিচিত বিভিন্ন ব্যাংকের সাতজন নারী কর্মকর্তাকে চাকরি ছাড়তে দেখেছি। এ ছাড়া ক্রেডিট বিভাগেও নারীদের অন্তর্ভুক্তি কম। এসব ঘটনা বেশির ভাগ ব্যাংকে নারী কর্মীদের জন্য অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, ‘দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে সংকট চলছে। তাই নারী কর্মীদের জন্য আদর্শ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বেশির ভাগ ব্যাংক মনোযোগ দিতে পারছে না। ব্যাংকগুলো এখন খেলাপি ঋণ ও সংকট উত্তরণে ব্যস্ত। এছাড়া দেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক কারণেও নারীরা কর্মজীবনের অনেক সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন না। তবে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত ও কিছু সুবিধা বাড়ানো গেলে ব্যাংক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংক খাতে এত কিছু হয়ে গেলেও এখনো কারো বিচার হয়নি। সর্বশেষ তথ্য মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ, অর্থপাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিষয়ে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। সেগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। অনুসন্ধানে কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন