আইএমএফ’র চাপে বিদ্যুতের ভর্তুকি বন্ধের রোডম্যাপ!

বিদ্যুৎ খাতকে ভর্তুকি মুক্ত করার রোডম্যাপ আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এমন বাধ্যবাধকতার বিষয় উঠে এসেছে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি বৈঠকে।
আজ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) বিদ্যুৎ ভবনের মুক্তি হলের বোর্ড রুমে ওই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি, বিআইডিএস, সমাজসেবা অধিদফতর, বিইআরসিসহ বিভিন্ন দফতর সংস্থার কর্মকর্তারা অংশ নেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা। তিনি বলেছেন, ভর্তুকির বিষয়টি নিয়ে কমিটি কাজ করছে। আমরা আজকে মিটিং করেছি, তাদেরকে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। এখন এটুকু বলতে পারি।
এর আগে, আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ২০২৪ সালের মার্চে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে আবার কমে গেলে কমবে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের শর্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে ব্যর্থ হলে আইএমএফ’র পরবর্তী ঋণের কিস্তি ছাড়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৩ বছরের মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ জমা দিতে বলা হয়েছে। সরকার নিজে উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি এবং বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে। বর্তমানে গড় উৎপাদন খরচ প্রায় ১২ টাকার মতো পড়লেও ৭ টাকা ৪ পয়সা দরে বিক্রি করছে। এতে করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৫৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২ দশমিক ১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৩ দশমিক ১৬ টাকা আর ২০২২ সালে সাড়ে ৮ টাকার মতো, এখন গড় উৎপাদন খরচ ১২ টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ লাফিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ।
বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৮ হাজার ১৩২ মেগাওয়াট আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দৈনিক গড়ে ১১ হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেকার বসে থেকেছে। বেকার বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে গিয়ে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ লাফিয়ে বাড়ছে বলে মনে করেন অনেকেই।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক সুত্র জানিয়েছে, অনেক ধরণের মতামত উঠে এসেছে, এরমধ্যে বিদ্যুতের বিভিন্ন স্ল্যাব তুলে দিয়ে অভিন্ন দরের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকেই ওই প্রস্তাব তোলা হয়।
আরও পড়ুনপ্রসঙ্গত, বিদ্যুতের ব্যবহারের পরিমাণ ভেদে ৬টি স্ল্যাব (স্তর) বিদ্যমান রয়েছে। এরমধ্যে একটি স্তর রয়েছে ৫০ কিলোওয়ার্ট আওয়ার, যাদেরকে লাইফলাইন গ্রাহক বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ওই স্তর পদ্ধতি চালু করেছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল যাদের বিদ্যুতের ব্যবহার কম তারা তুলনামূলক কম দাম দেবেন। অর্থাৎ যারা ফ্রিজ, এসির মতো বিলাসী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে তারা ধনিক শ্রেণি তাদের বিদ্যুতের বিল বেশি হবে। আর গ্রামের দরিদ্র পরিবারটি যারা একটি লাইট ও একটি ফ্যান ব্যবহার করে তাদেরকে ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। এখানে বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়।
আরেকটি সুপারিশ এসেছে টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে সরকার যেভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যপণ্য দিচ্ছে। ওই কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে বিদ্যুৎ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, হতে পারে নগদ সহায়তা।
গ্রাহক পর্যায়ের পাশাপাশি সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার দিকে নজর দিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এ জন্য বিদ্যুতের ক্রয় চুক্তি রিভিউ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরকারি মালিকানাধীন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির চুক্তি রিভিউয়ের কাজ চলমান রয়েছে। কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে করে গড় উৎপাদন খরচ কমে আসবে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
তবে বিষয়টিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন অনেকেই। তারা মনে করছে, ট্যারিফ খুব বেশি কমালে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। এতে বড়ধরনের সংস্কার এবং বিনিয়োগের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে কোম্পানিগুলো। যা পরবতী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় এবং উন্নয়ন ব্যহত করতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছে সুষ্ঠু পরিকল্পনার কথা। যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তুলনামূলক দক্ষ সেগুলোর উৎপাদন বেশি করা। বিশেষ করে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জোর দেওয়া। যদিও লিস্ট কস্ট জেনারেশনের কথা বলা হয়,অর্থাৎ যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাশ্রয়ী সেগুলো আগে চালানো কথা।
কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন, ১৭ সেপ্টেম্বরও মেঘনাঘাটে দক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে তুলনামূলক অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। আবার সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সাশ্রয়ী খ্যাত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পুরোমাত্রায় চালানো যাচ্ছে না। ক্যাব মনে করে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া গেলে বিদ্যুতের খরচ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
মন্তব্য করুন