এবার এনসিপি থেকে পদত্যাগ করে যা বললেন তাজনূভা জাবীন
এবার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে পদত্যাগ করলেন এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। নির্বাচনেও অংশ নিবেন না তিনি। আজ রোববার (২৮ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা জানান। ঢাকা-১৭ আসন থেকে এনসিপি’র হয়ে লড়ার কথা ছিল তার।
পোস্টে তাজনূভা জাবীন লেখেন, ‘আপনারা অনেকে ভাবছেন, হয়তো জামায়াতের সাথে জোটে ঐতিহাসিক কারণ বা নারী বিষয়ের কারণে আমার আপত্তি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর যে কারণ, সেটা হল যে প্রক্রিয়ায় এটা হয়েছে। এটাকে রাজনৈতিক কৌশল, নির্বাচনী জোট ইত্যাদি লেভেল দেয়া হচ্ছে। আমি বলব এটা পরিকল্পিত। এটাকে সাজিয়ে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে।’ তিনি লেখেন, ‘এটা আদর্শের চেয়েও অনেক বড়, সেটা হল বিশ্বাস। মাত্র কিছুদিন আগে সমারোহে সারাদেশ থেকে মনোনয়ন সংগ্রহের ডাক দিয়ে ১২৫ জনকে মনোনয়ন দিয়ে ৩০ জনের জন্য সীট সমঝোতা করে বাকিদের নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তে সীল মোহর বসানো হয়েছে। বিষয়টা ঠেলতে ঠেলতে একদম শেষ অবধি এনেছে যাতে কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচনও করতে না পারে। আগামীকাল মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ তারিখ। আমার অবশ্য এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ইচ্ছা নাই। পুরো অগোছালো করে চোখের পলকে ডিসউন করে দিয়েছে।’
জাবীন লেখেন, ‘ বিভিন্ন পত্রিকায় নানান খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আমি মনোনয়ন হারানোর ভয়ে জোটের বিরোধিতা করছি। আমি কিছুদিন আগে লিখেওছিলাম আমার আসনে নেগোনিয়েশন হলে আমি নির্বাচন করব না, যত কঠিন প্রতিপক্ষ হোক আমি ফাইট দেব। দিলো না। তাদের গোষ্ঠীর ভাইরা তাদের পক্ষে দিস্তায় দিস্তায় লিখে ভরায় ফেলছে কেন আর কিভাবে এই জোট। কিন্তু কোন জেনারেল, ইসি মিটিং এর সিদ্ধান্ত এরকম ছিল না জোট হলে বাকি আসনে প্রার্থীকে বসে যেতে হবে। আবার বাকি আসনগুলোতে জামায়াতের হয়ে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা করতে হবে।’ জামায়াতের সাথে চরমোনাই পীরের ৭০ টা আসনে সমঝোতা হচ্ছে। আর গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেয়া দলের ৩০টা আসনে-এ কথা উল্লেখ করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, এনসিপি শুরু থেকে যে গণপরিষদ, সেকেন্ড রিপাবলিক মধ্যপন্থার, নারী, বিভিন্ন জাতিসত্তাকে নিয়ে রাজনীতি করার কথা বলছে সেটা ধারণ করে যে কয়জন পার্টিতে ছিল তাদের মধ্যে আমি একজন। এই পার্টির একজন ফাউন্ডার মেম্বার আমি। স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ মন খারাপ। কিন্তু এই দল ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোন সম্মানজনক অপশন নাই। দলের খারাপ সময়ে দল ছেড়ে দিয়ে অরাজনৈতিক, অপরিপক্কতার পরিচয় ইত্যাদি বয়ান দিবে অনেকে। জাস্ট বুলশিট। শুধু এটুকু বলি, আমি বহিরাগত ওখানে, আমাকে প্রতারিত করলে মেইক সেন্স। কিন্তু এক শীর্ষ নেতা আরেক শীর্ষ নেতার সাথে যে মাইনাসের রাজনীতি করে ওখানে সেটা ভয়ঙ্কর। এরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করতে এতো ব্যস্ত এরা কখনো দেশের জন্য নতুন একটা মধ্যপন্থার বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করতে পারবে না।’
এনসিপির এই সাবেক নেত্রী বলেন, ‘সবাই খুব বলছেন কালকে থেকে, রাজনীতি লম্বা, অনেক দূর যেতে হয়। একদম ঠিক। কিন্তু সেই নীতি এনসিপির নিজেরই নাই। নেতারা বিতর্কের পর বিতর্ক জন্ম দিয়ে সেটাকে বিপ্লব নাম দিয়েছে আর আমাদের মত যারা আসলেই এনসিপির নীতি ধারণ করেছি তাদের আবেগী লেবেল দেয়া হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণাপত্র থেকে শুরু করে সবশেষ ডেইলি স্টারের ডিবেটে বলা কথা শীর্ষ নেতারা কতটুকু ধারণ করে সময় মতো মিলিয়ে নিয়েন। ওই পুরোনো ফাঁকা বুলির রাজনীতি করতে হলে পুরোনো দলই করতাম, নতুন কেন? এবার আবারও আসি, জামায়াতের সাথে জোট প্রসঙ্গে, এনসিপি স্বতন্ত্র স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে যে কারো সাথে রাজনৈতিক জোটে অসুবিধা ছিল না। সেটা ৫ বছর পরে হতো, ঠিক প্রথম নির্বাচনেই কেন? কিন্তু আর সব অপশনকে ধীরে ধীরে রাজনীতি করে বাদ দেয়া হয়েছে যাতে জামায়াতের সাথে জোট ছাড়া কোন উপায় না থাকে। সুনিপুণভাবে এখানে এনে অনেককে জিম্মি করা হয়েছে। যাই হোক। এটা কোন রাজনৈতিক কৌশল না। এটাই পরিকল্পনা।’ তিনি লেখেন, ‘এই লেখার পরে আমার উপর অনেক আক্রমণ আসবে। আমার অনেক ব্যর্থতার ঢালি সাজানো হবে। চরিত্রহননের চেষ্টা হবে। কিন্তু নিজের কাছে নিশ্চিত। আমি এদের সাথে রাজনীতি করতে এসেছিলাম, এদের বিরুদ্ধে না। আমার আজকে মনোনয়ন জমা দেয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করার কথা, আর আমি এখানে বসে এসব লিখছি। জোট নাকি হবে দেড় মাসের, তারপর তারা মধ্যপন্থায় ব্যাক বাউন্স করবে। ট্রু। ব্যাক করে আবার দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি শুরু করবে। যে জবাবদিহিতার কথা বলে এরা মুখে ফেনা তুলে, সেটা নিজেদের কেউ করলে তাকেই মাইনাস করে।
আমি আগে রাজনীতি করি নাই, ঠিক। কিন্তু এরা কে আগে জাতীয় রাজনীতি করেছে? আমি নিজে বের হয়ে দলের বদনাম করছি, বলতে পারেন। বিষয়টা আমারও ভালো লাগছে না। কিন্তু সেটার থেকে আমার কাছে বেশি জরুরি মানুষ যে এনসিপির দিকে তাকিয়ে আছে, এনসিপিকে এটা সেটা ভেবে, এনসিপি ওটা না। এনসিপিকে আমরা যারা ওটা করতে চেয়েছি তাদেরকে ট্যাগিং করা হয়েছে নানাভাবে। আমরা যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, তারা একে একে ছাড়ছি। যাতে এই এনার্জিটা গঠনে ব্যয় হয়, এই চেষ্টাটা প্রোডাকটিভ ভাবে করতে পারি। এখন কলুর বলদ খাটছি।
আরও পড়ুননিজেরও ভাল লাগছে না, এভাবে ছেড়ে যেতে। কিন্ত যারা এই দেশ, এই সংসদই চায় নাই তাদের সমঝোতায় একদম শুরুতেই এমপি হতে চাওয়া, বা যারা এদের কল্যাণে এমপি হওয়ার জন্য হাভাইত্তার মতো করছে তাদের নেতৃত্ব মানা আমার পক্ষে ঠিক গণঅভ্যুত্থানের পরের বছর অসম্ভব। এই জিনিস হজম করে মরতেও পারব না আমি। আমার নেতা হবে মাজাওয়ালা, জুলাই রাজনীতির ধারক। কিন্তু পুরো জুলাইকে নিয়ে রাজনৈতিক কৌশলের নাম করে তুলে দিচ্ছে জামায়াতের হাতে। আবার নাকি বাউন্স ব্যাক করবে। হাস্যকর। বিএনপি, এই জামাতের সাথে জোট করে ১৭ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল। আর বিএনপির অধীনে জামায়াতের সাথে জোট হয়েছিল। জামায়াতের অধীনে না। যেখানে এনসিপিকে বলাই হয় জামায়াতের আরেকটা দোকান, তাহলে কেন এনসিপি আগে নিজের স্বকীয়তা, নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াতকে বেছে নিতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছে? তিনজন মন্ত্রী ছিল না ক্ষমতায়? পারে নাই তো।’
জাবীন লেখেন, ‘ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা যায় কৌশল করে, কিন্তু সংগঠন দাঁড় করাতে যোগ্যতা লাগে। আপনারা মিলায় নেবেন, যারা এনসিপি ছাড়ছি তারাই এনসিপির বলা নয়া বন্দোবস্তের রাজনীতি করেছি। কিন্তু ছাড়তে হচ্ছে আমাদের। পার্টিতে থাকা অবস্থায় কোন শোকজ না পেয়ে, সম্পূর্ণ পার্টির ইন্টিগ্রিটি মেনে যখন ছেড়ে আসতে চাই, তখন “অরাজনৈতিক” তকমা পরে। আপনারা এটাও মিলায় দেখেন কত কয়েকমাসে কোন কোন নেতা কত অসংখ্যবার পাটির ইন্টিগ্রিটি ভেঙে বক্তব্য দিয়েছে, বিভিন্ন কাজ করেছে কিন্তু তারা মিলিয়ন ফলোয়ার ওয়ালা গণঅভ্যুত্থানের নেতা তাই তারা নির্বাচনী জোটের নামে বাকিদের নির্বাচন করার অধিকার কেড়ে নিয়ে এমপি হতে পারেন আর আমরা পদত্যাগও করতে পারব না। সেটাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হবে।’
তিনি লেখেন, ‘নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রচুর পজিটিভ পিআর হবে এসকল নেতাদের ঘিরে। কিন্তু আমি নিশ্চিত এরা নয়া বন্দোবস্ত না, এরা মধ্যপন্থার রাজনীতি না। আপনারা বলতে পারেন, এসব আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু এই দলে অনেকে আছে/ছিল যারা আদৌতেই এনসিপি’র রাজনীতি করেছে। তাদেরকে এম্পাওআরড করা হয় নাই ইচ্ছাকৃতভাবে। আপনারা তাদেরই চেনেন যাদের এনসিপি চেনাতে চেয়েছে। জুলাই এর যে স্পিরিট সেটা এনসিপিতে চর্চা করা হয় না, ব্যবহার করা হয়। যারা চর্চা করত, তাদের ‘নীতি কথা বলা যায় অনেক, বিপ্লব দিয়ে রাজনীতি হয় না, আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না’ ইত্যাদি বলে থামানো হয়, যাতে তারা নিজেদের ভন্ডামি চালিয়ে যেতে পারে।
আরেকটা বিষয় দেখলাম, বিএনপি গণভোটে না ভোটকে জেতায় আনবে তাই সেটা ঠেকানোর জন্য এই কৌশল। আমার প্রশ্ন, হ্যাঁ ভোট জেতানোর জন্য এনসিপিকে ৩০টা আসনে সীমিত হতে হল???? যে লিস্ট ঘুরছে তাদের ৬০-৭০% এর রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেন। আমার চেয়ে ভাল জানবেন। এরপরও এনসিপির জোর করে চেপে বসে থাকা নেতাদের মধ্যে যদি এনসিপির রাজনীতি নিয়ে পরিকল্পনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখতাম, জবাবদিহিতা পেতাম, তাহলে আমি আরও চেষ্টা করতাম টিকে থাকার। এখন সময় নষ্ট না করি আর।’ জাবীন লেখেন, ‘ভেবেছিলাম, জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর আমি পদত্যাগ দেবো। শেষ আশাই ছিলাম। কিন্তু গতকাল সবাই নিশ্চিত করেছে এই জোটে সীল পড়েছে। আর আবারও বলি, আমার পদত্যাগের কারণ যতটা না জোট তার চেয়ে বেশি যে প্রক্রিয়ায় জোট হয়েছে। অবিশ্বাস, অনাস্থা মূল কারণ। দল অনেক বড় হয়ে স্টাবলিশ করতে পারলে অনেক কিছু বিবেচনা করে ছাড় দেয়া যেত কিন্তু গঠনের শুরুটাই নাকি আগে সংসদে যেতে হবে, তারপর ওই যে কজন এমপি বের হবে তাদেরকে কেন্দ্র করে নাকি সংগঠন বড় হবে। কিয়েক্টাবস্থা। যাই হোক, আমি আজকে পদত্যাগ করেছি এনসিপি থেকে। অত্যন্ত ভাঙ্গা মন নিয়ে জানাচ্ছি আমি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছি না। সবচেয়ে কষ্ট লাগছে আজকেই আম্মু চট্টগ্রাম থেকে আসছে আমার নির্বাচন করা উপলক্ষে, আর আজকেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। আমি জানি অনেকে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন আমার এই সিদ্ধান্তে। কিন্তু এটাই আমার জন্য সঠিক। এখানে ন্যুনতম আশা থাকলে, আমি আমার আত্মসম্মানবোধকেও বোধ হয় ডাউট অফ বেনিফিট দিতাম।’ দলের জন্য তোলা ফান্ড ফেরত দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি লেখেন, ‘আমি আপনাদের পাঠানো ডোনেশন ফেরত দেব এক এক করে। আমাকে একটু সময় দেবেন। সেটার জন্য বিস্তারিত লিখে আপডেট দেব কিভাবে ধীরে ধীরে ফেরত দেব। প্রত্যেকটা পয়সা ফেরত দেব। আপনাদের সমর্থন, আপনাদের ভালোবাসার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’
জাবীন আরও লেখেন ‘শেষ কথা বলি, আমি আগে কখনো রাজনীতি করি নাই। জুলাই এ আমার রাজপথে নামা, পরিবর্তনের লক্ষ্যে নতুন কিছুর জন্য। আমি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই চেষ্টা করতে থাকব। আমার আওয়াজ, দেশের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য কাজ আরও জোরালোভাবে জারি থাকবে। মধ্যপন্থার বাংলাদেশ পন্থী নয়া বন্দোবস্তের রাজনীতির জায়গাটা খালিই পরে থাকল। আমি ওই জায়গা পূরণ করার চেষ্টায় থাকব। সময় বলে দিবে বাকিটা।’
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক







