ভিডিও শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২২ কার্তিক ১৪৩২

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর, ২০২৫, ০৫:২১ বিকাল

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের শিক্ষা 

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের শিক্ষা। ছবি : দৈনিক করতোয়া

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ একটি যুগান্তকারী দিন। একে কেউ বলেন “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস”, কেউ “সেনা অভ্যুত্থান দিবস”, আবার কেউ “সিপাহি-জনতার বিদ্রোহ” হিসেবে আখ্যা দেন। নানা ব্যাখ্যা ও বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও, ইতিহাসের নিরিখে এটি ছিল রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সূচনা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রত্যাবর্তন এবং নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ। ৭ নভেম্বর শুধু অতীতের এক সামরিক ঘটনা নয়— এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তা, নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক যাত্রার এক ঐতিহাসিক বাঁক। আজকের বাংলাদেশে এই দিনের শিক্ষা কতটা প্রাসঙ্গিক সেটিই এখন আলোচনার বিষয়।

স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পর, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক এক গভীর সংকট। মুক্তিযুদ্ধের পর গঠিত রাষ্ট্র তখন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য সংকট ও রাজনৈতিক অসন্তোষে বিপর্যস্ত। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের নির্মম হত্যাকান্ড রাষ্ট্রের মূল কাঠামো ভেঙে দেয়। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে, সেনাবাহিনীর ভেতরে শুরু হয় ষড়যন্ত্র ও পাল্টা ষড়যন্ত্র।

খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে। এই অস্থির পরিবেশে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোদ্ধারা ক্ষমতা দখল করেন শেখ মুজিব হত্যাকান্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের অপসারণ করেন এবং তৎকালীন উপপ্রধান সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে রাখেন। কিন্তু ইতিহাসের চাকা ঘুরতে দেরি হয়নি। মাত্র চার দিন পর, ৭ নভেম্বর সকালে শুরু হয় এক অভূতপূর্ব ঘটনা যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় রচনা করে।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভোরে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে নিম্নপদস্থ সৈনিকদের মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়। খুব দ্রুতই তা ‘সিপাহি-জনতার আন্দোলন’ রূপ নেয়। “সিপাহি-জনতার ঐক্য অটুট থাকুক”, “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ”, “জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ” এসব স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী জুড়ে।

এই আন্দোলনে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল)-এর প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। তাদের নেতা কর্নেল (অব.) তাহের এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তাঁদের মূল দাবি ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের ব্যবস্থা, এবং প্রকৃত “জনগণের সরকার” প্রতিষ্ঠা। আন্দোলনের বিস্ফোরণে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দার নিহত হন। বন্দি জিয়াউর রহমান মুক্ত হন এবং সেনা ও জনগণ তাঁর নেতৃত্বে আনুগত্য ঘোষণা করে। এরপর থেকেই ইতিহাসে নতুন এক নাম স্পষ্ট হয়ে ওঠে জিয়াউর রহমান।

৭ নভেম্বরের ঘটনাকে অনেকেই বাংলাদেশের “রাষ্ট্রীয় পুনর্জন্ম” বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, এদিনের পরই দেশে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় যে নীতি গ্রহণ করেন, তা ছিল মূলত পুনর্গঠন ও সংহতির ভিত্তিতে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শহীদ জিয়া প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, সেনাবাহিনীতে বিভাজন দূর করা, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সরকারি কাজে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন এবং তাতে সফলও হন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু যে একদলীয় ব্যবস্থা (বাকশাল) প্রবর্তন করেছিলেন, তা বাতিল করে জিয়া ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় রাজনীতি পুনরায় চালু করেন। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও সক্রিয় হয়, জনগণ রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুযোগ পায়।

জেনারেল জিয়াউর রহমান  রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” ধারণা দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিচয় শুধু বাঙালিত্বে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বহুমাত্রিকতার সম্মিলন। জিয়া ‘উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা’ স্লোগান দেন। তাঁর সময়েই প্রথম “স্বনির্ভর বাংলাদেশ” ধারণাটি রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে গৃহীত হয়। কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টি এবং বিকেন্দ্রীকরণে তিনি নজির স্থাপন করেন।

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস নিয়ে ইতিহাসের ব্যাখ্যা ও বিতর্ক সমাজে আজও বিদ্যমান। ৭ নভেম্বরের ঘটনাকে নিয়ে ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের মধ্যে বহু মতপার্থক্য রয়েছে। একটি দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, এটি ছিল একটি গণবিপ্লব যেখানে সেনা ও সাধারণ মানুষ মিলে শৃঙ্খলাভঙ্গকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের অপসারণ করে জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। অন্য দৃষ্টিকোণ বলছে, এটি ছিল একটি সেনা বিদ্রোহ, যার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে এবং সামরিক রাজনীতির পথ খুলে দেয়। তবে ইতিহাসের নিরপেক্ষ মূল্যায়নে দেখা যায়, ৭ নভেম্বরের ঘটনাই রাষ্ট্রকে একটি স্থিতিশীল পথে ফিরিয়ে আনে, যার ফলেই বাংলাদেশ আবার উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

৭ নভেম্বর আমাদেরকে তিনটি বড় শিক্ষা দেয় :  (১) জাতীয় ঐক্যের অপরিহার্যতা: বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের পর বিভক্তিতে ভুগেছে রাজনৈতিক মতবিরোধ, আঞ্চলিক বিভাজন, আদর্শগত বিরোধ। ৭ নভেম্বর প্রমাণ করে, সংকটের সময় জাতি এক হতে পারলে বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। সৈনিক ও নাগরিকের ঐক্য রাষ্ট্রকে রক্ষা করেছিল। আজও এই ঐক্যের চেতনা আমাদের প্রয়োজন বিশেষ করে রাজনৈতিক সহনশীলতার ক্ষেত্রে।

(২) নেতৃত্বে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা: ৭ নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমান যে নেতৃত্ব দেখিয়েছিলেন তা ছিল বাস্তববাদী ও রাষ্ট্রগঠনমুখী। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রতিশোধ নয়, বরং পুনর্গঠনকে প্রাধান্য দেন। এই দৃষ্টান্ত বর্তমান রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিক, যেখানে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হয়।

আরও পড়ুন

(৩) আত্মনির্ভর উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কার: জিয়ার যুগে যে উন্নয়ন দর্শন দেখা যায় তৃণমূলভিত্তিক বিকাশ, বিকেন্দ্রীকরণ ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতি তা আজকের সময়েও প্রাসঙ্গিক। দেশ যখন বৈদেশিক ঋণনির্ভর অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছে, তখন ৭ নভেম্বরের শিক্ষা আমাদের স্মরণ করায় আত্মনির্ভরতা ও স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার কতটা জরুরি।

আজকের বাংলাদেশ ও ৭ নভেম্বরের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায যে, আজ দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার সংকট এখনো গভীর। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস, প্রশাসনে দলীয়করণ, ও নাগরিক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এসব সমস্যায় ৭ নভেম্বরের “জাতীয় সংহতির শিক্ষা” আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রে যে ধরনের মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে, তা ১৯৭৫ সালের বিভাজনেরই এক নতুন রূপ।

৭ নভেম্বরের অন্যতম বার্তা ছিল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও উন্নয়ন কোনো একক দলের নয়, এটি সমগ্র জাতির যৌথ দায়িত্ব। তাই আজকের বাংলাদেশে প্রয়োজন সেই ঐক্যের চেতনা যেখানে রাজনৈতিক বিভাজন নয়, বরং জাতির অগ্রগতি হবে মুখ্য লক্ষ্য। রাষ্ট্রচিন্তা ও নাগরিক চেতনায় ৭ নভেম্বরের মূল দর্শন ছিল জনগণই রাষ্ট্রের ভিত্তি। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেনা ও জনগণের এই ঐক্য জাতীয়তাবাদকে নতুন রূপ দেয়। তাঁর প্রবর্তিত “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” পরবর্তীকালে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

এই দর্শন আজও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলাদেশ আজ বৈশ্বিক প্রভাব, সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে নতুন পরিচয়-সংকটে ভুগছে। জাতীয় পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ চিন্তা ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না ৭ নভেম্বর সেই ঐতিহাসিক সত্যের প্রতীক। ৭ নভেম্বর দীর্ঘ সময় ধরে জাতীয়ভাবে “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস” হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। বিএনপি ও এর সমর্থকরা দিনটিকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও অনেক ইতিহাসবিদ একে সামরিক বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যা দেয়। ১৯৯৬ সালে বিগত পতিত আওয়ামী লীগ সরকার এ দিবসের সরকারি মর্যাদা বাতিল করে। কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতায় ৭ নভেম্বর আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক অনিবার্য অধ্যায়। আজ যখন গণতন্ত্রের মৌলিক চর্চা সীমিত, তখন এই দিবসের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্রের স্থিতি কেবল ক্ষমতার দখলে নয়, বরং জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণেই নিহিত।

৭ নভেম্বরের শিক্ষা হলো : রাষ্ট্র কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে পারে না; গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হয়; জাতীয় ঐক্য ও আত্মনির্ভর উন্নয়নই রাষ্ট্রের স্থিতির ভিত্তি। আজকের বাংলাদেশে এই শিক্ষাগুলোই সবচেয়ে প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এখন ভাবতে হবে ৭ নভেম্বরের “সংহতির চেতনা”কে কীভাবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের পথে রূপান্তরিত করা যায়। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ শুধু ইতিহাসের একটি দিন নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক চেতনার এক প্রতীক।

এই দিনে আমরা শিখেছি সংকট যত গভীরই হোক, জাতীয় ঐক্যই পারে রাষ্ট্রকে পুনরুত্থিত করতে। আজকের বাংলাদেশে যখন রাজনীতি বিভাজিত, অর্থনীতি বৈদেশিক নির্ভরতামুখী, আর সমাজে আস্থার সংকট প্রকট তখন ৭ নভেম্বরের শিক্ষা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্রের স্থিতি ও অগ্রগতি কেবল তখনই সম্ভব, যখন সিপাহি ও জনতা, নেতা ও নাগরিক, শহর ও গ্রাম সবাই এক সুরে বলে: “আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, এবং এই রাষ্ট্রই আমাদের সম্মিলিত স্বপ্ন।”

প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী
লেখকঃ উপাচার্য, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়

drhasnat77@gmail.com

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শনিবার থেকে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা প্রাথমিক শিক্ষকদের

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে বাদল হত্যার আসামি গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

ঢাকায় আসছেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কাফু

সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, সতর্ক থাকার অনুরোধ

বগুড়ায় জামায়াত প্রার্থী সোহেলের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা

রাজস্থানেই বিয়ে করবেন বিজয়-রাশমিকা