আজ বিশ্ব ডাক দিবস
মেইল-চ্যাটিংয়ের যুগেও আস্থা ধরে রেখেছে ডাক বিভাগ

নাসিমা সুলতানা ছুটু : চিঠি, চিঠি। রাফিয়ার চিঠি। সপ্তাহে অন্তত দুইবার এভাবেই ডাকপিওন এসে ডাক দিতেন রাফিয়াকে। কোনো সপ্তাহে পিওনের ডাক কানে না এলে মনের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করতো বলে জানান, কলেজ শিক্ষক রাফিয়া হক। খামের ওপর রাফিয়ার নাম লেখা থাকলেও ভেতরের চিঠিগুলোর মালিক ছিলেন তার বন্ধু তামান্না। প্রায় আড়াই দশকেরও আগের ঘটনা। তখন রাফিয়া এবং তামান্না দু’জনই কলেজে পড়তেন। তামান্নার খুব শখ পত্রমিতালি করা, কিন্তু পরিবার রক্ষণশীল হওয়ায় ভয় পেতেন তামান্না। চিঠি এলে বড়দের বিভিন্ন জবাবদিহিতার মুখে শেষে না কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বান্ধবীর এই সঙ্কট দেখে তার শখ পূরণ করতেই রাফিয়া তাকে সহযোগিতা করেন। রাফিয়া বলেন, কোনো সপ্তাহে যদি ডাক না আসতো, তাহলে তামান্নার সঙ্গে আমারও মন খারাপ হয়ে যেতো। কারণ খামের ভেতরের লেখাগুলো আমরা দু’জন মিলে একসঙ্গে পড়তাম। একজনের নামের চিঠি দু’জনের আবেগেই মিশে গিয়েছিল বলে জানান রাফিয়া। এখন সবই স্মৃতি। এরপর বহু বছর কেটে গেছে, কিন্ত হলুদ খামে করে আর চিঠি পাওয়া হয়নি রাফিয়ার।
রাফিয়ার মত হলুদ বা নীল খামে কবে আপনি চিঠি পেয়েছিলেন বা কাউকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, মনে আছে কী? হাতের আঙ্গুলে গুণেও মনে করে বের করতে পারছেন না! তবে আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় শেষ কবে মেইল অথবা সোস্যাল মিডিয়ায় চ্যাট করেছেন? এর উত্তরটা এমন হতে পারে এই লেখা পড়তে পড়তেই চ্যাট করছি, অথবা কয়েক সেকেন্ড আগে মেইল পাঠিয়েছি। হঠাৎই আজ কেনোই বা চিঠির প্রসঙ্গ আসছে। কেননা আজ বিশ্ব ডাক দিবস।
ইন্টারনেটের এই যুগে প্রয়োজন কমেছে ডাক যোগাযোগের। এখন আর দরকার হয় না চিঠি লেখার। তবু দিনটা যে রয়ে গিয়েছে। ১৮৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে এ দিনই তৈরি হয়েছিল ‘ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন’। আর সে দিনটিতেই পৃথিবীর জুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব ডাক দিবস’। নীল বা হলুদ খামে একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি এখন আর কারো না এলেও ডাক বিভাগ বেঁচে আছে। কেনো না, এখনও সরকারি চিঠি ও সমন ডাকে পাঠানো হয় বা কোনো নির্দেশনামা বা বিল পাঠানোর জন্য ডাকই ভরসা। অথচ এক দশক আগেও কারোর জন্য আনন্দ সংবাদ বা কারোর জন্য দুঃখের খবর পৌঁছে দিতেন ডাকপিয়নরা। তবে এখন আর তেমনটা হয় না। এখন বেশিরভাগ পোস্ট অফিসগুলোতে ব্যাংঙ্কিং কাজকর্ম হয়। পেনশন বা বেতন দেয়া হয় বহু সংস্থার। এছাড়াও দেশ-বিদেশে পার্সেল পাঠানোর জন্য এখনও ডাক বিভাগের প্রতিই মানুষের আস্থা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমাম পদে রেজিস্ট্রি করে আবেদন পাঠাতে জয়পুরহাট থেকে বগুড়ায় এসেছেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, জয়পুরহাট থেকে ডাক পাঠালে পাবনায় পৌঁছুতে দেরি হবে, এখান থেকে পাঠালে কর্তৃপক্ষ দ্রুত চিঠি পাবেন। একটি সরকারি দপ্তরের অনিয়ম নিয়ে একজন উপদেষ্টার কাছে চিঠি রেজিস্ট্রি করতে এসেছেন বগুড়া সদরের জয়পুরপাড়ার বাসিন্দা ইউসুফ। তিনি জানালেন, সরকারি রেজিস্ট্রি চিঠি অবশ্যই উপদেষ্টা পাবেন এবং এজন্যই পোস্ট অফিসে আসা। বগুড়া প্রধান ডাকঘরের চিঠি রেজিস্ট্রি বিভাগের এক স্টাফ জানান, দিনে গড়ে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ চিঠি এখনও রেজিস্ট্রি হয়, সবই সরকারি। ব্যক্তিগত চিঠি এখন আর একেবারে আসে না বলে তিনি জানান।
ডাক বিভাগের অনেক কার্যক্রমকে অনলাইনের আওতায় আনা হলেও জনবল ও পরিবহন সঙ্কটসহ এখনও রয়ে গেছে কিছু সমস্যা।
বগুড়া ডাক বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বগুড়া প্রধান ডাক বিভাগ থেকে ৫ লাখ ২৭ হাজার ২১৭টি চিঠি ও পার্সেল বিলি করা হয়েছে। তবে ২০২৩-২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে বেশি বুকড হয়েছে। এই বছরে গত ৯ মাসেই ১ লাখ ৮৪ হাজার ২৫০টি চিঠি ও ও পার্সেল পাঠানো হয়েছে। ২০২৪ সালে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৭৩টি এবং ২০২৩ সালে ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৯৪টি চিঠি ও পার্সেল পাঠানো হয়েছে।
বগুড়া প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল কাম পোস্টমাস্টার আল আমিন জানান, পোস্ট অফিসে আগের মত ব্যক্তিগত চিঠি পোস্ট না করা হলেও বেশকিছু সেবা নতুন সংযোজন হয়েছে। যেমন-ইলেকট্রনিক্স মানি ট্রান্সফার, ইলেকট্রনিক্স ক্যাশ কার্ড, সেবা সঞ্চয়, পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, জিইপি, রাজস্ব ও ডাক টিকিট বিক্রি, পার্সেলসহ আরও বেশকিছু কাজ চলমান রয়েছে। তবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে পার্সেল পাঠাতে খরচ কম পরলেও কুরিয়ারগুলো দেশের মধ্যে অল্প সময়ে পৌঁছে দেয় বলে মানুষ কুরিয়ারগুলোতে বেশি পার্সেল পাঠায়। তবে দেশের বাইরে পার্সেল পাঠানোর জন্য মানুষ ডাক বিভাগকেই আস্থায় রেখেছেন। এজন্য আমাদের ফরেন পার্সেল বুকড হয় বেশি।
আরও পড়ুনতিনি আরও জানান, ডাক বিভাগকে ডিজিটালাইজড করা হলেরও কিছু সমস্য রয়েছে, যেমন-বগুড়ায় প্রায় ১৩০টি পদ থাকলেও জনবল তার অর্ধেকেরও কম রয়েছে। এছাড়া পার্সেল পাঠানোর জন্য পরিবহন সঙ্কটের পাশাপাশি তেলের বরাদ্দ নিয়েও সমস্যা রয়েছে। ডাক বিভাগের সোনালি অতীত কিছুটা হারিয়ে গেলেও ডাক বিভাগের কাছে বিশ্ব ডাক দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম।
২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্ব ডাক সংস্থার ১৪৫তম বার্ষিকে ১০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। এই ডাকটিকিটের রয়েছে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেটি হলো-ডাকটিকিটের ডিজাইন বিশ্ব ডাক সংস্থা থেকে পাঠানো হয় এবং একই নকশায় বিশ্ব ডাক সংস্থার সমস্ত সদস্য দেশ থেকে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়।
হোয়াটস্অ্যাপ, মেইল ও চ্যাটিংয়ের যুগে দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য সেবা আশা করে মানুষ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ হয়তো কিছুটা পিছিয়ে, দিতে পারছে না আশানুরূপ সেবাও। অথচ কুরিয়ার সার্ভিসের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ডাক বিভাগ সেবা দিয়ে আসছে।
মন্তব্য করুন