বাঘাইড় মাছ বিক্রিতে অভিযান
পোড়াদহ মেলায় ২৮ কেজির কাতল ও ১৫ কেজির মাছমিষ্টি, ২ কোটি টাকা বিক্রি

হাফিজা বিনা ও এনামুল হক : মাঘের ঘন কুয়াশা ও শীত উপেক্ষা করে ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই জনস্রোত বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলাকে উদ্দেশ্য করে। প্রাণের উচ্ছ্বাসে বছরের এই দিনে মেলবন্ধনে মিলতে সবাই যেন ছুটছে একটি মিলন মেলায়।
এভাবেই চারশ’ বছরের পুরনো বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা লাখো মানুষের পদচারনায় হয়ে মুখরিত হয়ে উঠে দিনভর। সারাদেশে এই মেলা বিখ্যাত হয়েছিল নদীর ১শ’ কেজি, ৭০ কেজির বাঘাইড় মাছের জন্য। গত তিন বছর হলো বিলুপ্তপ্রায় বাঘাইড় মাছ বেচা কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ জরিমানা ঘোষণার পর বাঘাইড় মাছ আমদানী, প্রদর্শন ও বিক্রি করতে দেখা না গেলেও আজ বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) মেলায় আবারও বাঘাইড় মাছ বিক্রি ও প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই মাছ বিক্রিতে অভিযান পরিচালনা করে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
মেলায় এবার বড় মাছের মধ্যে উঠেছিল ৩০ কেজির বাঘাইড় ও ২৮ কেজির কাতল। এছাড়াও বরাবরের মত মেলার ২য় আকর্ষণ ছিল ১০ থেকে ১৫ কেজির মাছ আকৃতির মিষ্টি। এবছর মেলায় প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ এবং মিষ্টি বেচা-কেনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজক আব্দুল মজিদ। প্রতি বছরের মতো আজ মহিষাবান গ্রামে অনুষ্ঠিত হবে বউমেলা।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়িতে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ও ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহের বুধবার সন্যাসী পূজা উপলক্ষে প্রায় ৪শ’ বছরের পুরানো এ ঐতিহ্যবাহী মেলা বসলেও এবার অনুষ্ঠিত হলো মাঘের শেষে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এবং বড় বড় মাছের জন্য পোড়াদহ মেলা সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মেলা উপলক্ষে মেলার আশেপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়ির জামাই-মেয়ে ও অতিথি আপ্যায়নে বড় মাছ কেনার রীতিও বহু পুরনো।
রীতি অনুযায়ী জামাইকে মেলা করার জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকেরা টাকা দেয়। আর জামাইও সেই টাকা রেখে শ্বশুরবাড়ির জন্য তার সাধ্য অনুযায়ী মেলা থেকে বড় মাছটি কিনে বাড়ি ফেরেন। এজন্যই এ মেলাকে জামাই মেলাও বলা হয়। মাছ ছাড়াও মেলায় প্রচুর আসবাবপত্র, বিভিন্ন সাইজের বড় মিষ্টি, পোশাক, বাঁশবেতের সামগ্রী, লোহার জিনিসপত্র, মেয়েদের প্রসাধনী সামগ্রী ছাড়াও ব্যাপক পরিমাণে পান খাওয়ার চুন পাওয়া যায়।
মেলাকে কেন্দ্র করে একদিন আগে থেকেই বগুড়াসহ আশেপাশের উপজেলাগুলোতে সাড়া পড়ে যায়। এদিন মেলা উপলক্ষ্যে বগুড়ার চাষীবাজারসহ বগুড়ার চেলোপাড়া, বৌ-বাজার, পাঁচমাইল বাজার, অদ্দিরগোলা বাজার এলাকায় মাছের বিপুল সমাহার দেখা যায় এবং মেলা এলাকার আশেপাশের সাবগ্রামেও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। মেলায় নাগরদোলা, মিনি ট্রেন, মোটরসাইকেল খেলা, যাদু প্রদর্শনী, ঘুর্ণি ছাড়াও আরও বিনোদনের ব্যবস্থায় মেতে উঠেছিল ছোটদের সাথে বড়রাও।
মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, এই মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকার মাছ ব্যবসায়ীরা বেশকিছুদিন আগে নদী ও পুকুরের বড় বড় মাছ হেপা করে বেঁধে রাখে। মেলায় প্রতি বছরের মত সিরাজগঞ্জ থেকে মাছ ব্যবসায়ী মোঃ আলিউল ইসলাম এসেছেন বিভিন্ন প্রজাতির ১০ লাখ টাকার মাছ নিয়ে। তিনি করতোয়া’কে জানান, কয়েকবছর পর এবার মেলা উপলক্ষে ৪৫ পিস বাঘাইড় মাছ এনেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় বাঘাইড়ের ওজন ৩০ কেজি। মেলার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় মাছ। তাই এই মাছকে কেন্দ্র করে দর্শনার্থী, ক্রেতা, সাংবাদিক, ইউটিউবারদের ভিড়ে অস্থির অবস্থা। বিক্রেতা মাছটির দাম হাঁকিয়েছেন ১৫শ’ টাকা কেজি করে।
আরও পড়ুনতার মতই গাবতলীর মহিষাবান এলাকার মাছ ব্যবসায়ী ও নওগাঁর মাছ ব্যবসায়ী মোঃ কলম ও রুহী দাস এনেছেন ২৮ কেজি ও ২৭ কেজির কাতলা মাছ। একই মাছগুলো মেলার ২য় আকর্ষণ। তারা জানান, এবার মেলা উপলক্ষে ১০ থেকে ২৮ কেজির কাতলা, বোয়াল ১৫ কেজি, ২০ কেজির ব্লাককার্প, ১০ কেজির রুই, ১০ কেজির পাঙ্গাস, সিলভারকার্প মাছ এনেছেন। তা ছাড়াও প্রায় শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী মাছ বিক্রি করছেন মেলায় আগত দর্শনার্থীদের কাছে।
এছাড়াও বড় ওজনের বোয়াল মাছের দাম হাকানো হয়েছে প্রতি কেজি ১৫শ টাকা, ২৮কেজির কাতলা মাছ ১৪’শ টাকা কেজি, ১০কেজি ওজনের আইড় মাছের দাম ১৫’শ টাকা কেজি, গুজি মাছ ১৪’শ টাকা কেজি, চিতল ১২’শ টাকা কেজি, রুই ৬’শ টাকা কেজি, বড় পাঙ্গাস ৫’শ টাকা কেজি, বড় ব্রিগেড ৫’শ টাকা কেজি, বড় ব্লাককার্প ৮’শ টাকা কেজি এবং সিলভার কার্প ৫’শ টাকা কেজি। এছাড়াও ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছও মেলায় বিভিন্ন দরে কেনা-বেচা হয়েছে।
এবারের মেলায় সবচেয়ে বড় মিষ্টি ছিলো সাড়ে ১২কেজি ওজনের-যার কেজি প্রতি বিক্রি করা হয়েছিলো ৮’শ টাকা। এবারও মেলায় বিশাল বিশাল মাছ ও মিষ্টির স্টলে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। মেলায় গাবতলীর সোনাকানিয়ার মিষ্টি ব্যবসায়ী মোকছেদুল ইসলামের মিষ্টির দোকানে মাছ আকৃতির ১৫ কেজি ওজনের মিষ্টি উঠেছিল যার প্রতি কেজির দাম ৫৫০ টাকা এবং একই গ্রামের আল-আমিন বলেন, মাছ আকৃতির ১৫ কেজি ওজনের মিষ্টিসহ ২শ’ ৫০ মণ মিষ্টি বেচা-কেনা হবে। তারা জানান, মেলায় আগত অন্যান্য এলাকার ক্রেতা ও জামাইদের কাছে এসব মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা। বেশিরভাগ সময় এ মিষ্টিগুলো আগেরদিনই বিক্রি হয়ে যায়। এবারও সব মিষ্টি শেষ হবে আশা করছেন তিনি।
মেলায় দেখা মেলে সদ্য জামাই হয়েছেন এমন দু’জন জামাই মো: জাহিদ হোসেন ও ইমরান এর সাথে। তারা আবার ভাইরা ভাই। বাড়ি গাবতলীর চকসদু গ্রামে। শ্বশুর বাড়ি পাচঁমাইল কর্ণিপাড়া। দু’জনের হাতেই দুটি বড় সাইজের সিলভারকার্প মাছ। বললেন, জামাই হিসেবে এবারই প্রথম তাদের মেলায় আসা। শ্বশুর তাদের দু’জনকে ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন মেলা করার জন্য।
মেলা এবং তারা নতুন জামাই হিসেবে তাদের বাড়িতে উৎসব আমেজ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও মেলা উপলক্ষে প্রতিটি আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হয়। এটা এ এলাকার জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। সাথে বড় বড় মাছ কেনাও এখন রেওয়াজ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে থানার ওসি আশিক ইকবাল বলেন, পোড়াদহ মেলাটি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে মেলা শুরুর আগের দিন থেকেই আইন শৃঙ্খলাবাহিনী দ্বারা কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেলাটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
মন্তব্য করুন