২০২৫ সালে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে ‘মব সন্ত্রাস’: আসক

২০২৫ সালে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে ‘মব সন্ত্রাস’: আসক

২০২৫ সাল জুড়ে ‘মব সন্ত্রাস’ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো ধরনের প্রমাণ, তদন্ত বা আইনিপ্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, সন্দেহ, গুজব সৃষ্টি করে মানুষকে মারধর ও হত্যা করা হয়েছে। ‘তওহীদি জনতা’র নামে বেআইনিভাবে মব তৈরি করে শিল্প-সংস্কৃতি কেন্দ্র ভাঙচুর, বাউল সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, এমনকি কবর থেকে তুলে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ বিরুদ্ধ মতের মানুষকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে।

এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে উদাসীনতার প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে, যা দেশে আইনের শাসনের জন্য চূড়ান্ত হুমকিস্বরূপ এবং সমাজে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) ২০২৫ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিস কেন্দ্রের  (আসক) এক পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য জানানো হয়।

মানবাধিকার সংস্থা আসক জানায়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন মানবাধিকারের বাস্তব পরিস্থিতিতে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং পুরনো নিপীড়ন-পদ্ধতির ধারাবাহিকতা নতুন রূপে বহমান রয়েছে।


দমন মূলক শাসন ব্যবস্থা, জবাবদিহিহীন এবং বৈষম্যমূলক আচরণকে নিষ্কণ্টকভাবে টিকিয়ে রেখেছে; যা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে সার্বিকভাবে অস্থির ও উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত মানবাধিকার সম্পর্কিত সংবাদ এবং আসকের পর্যবেক্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল বছর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচনের প্রবণতা দেখা গেছে। বিশেষ করে  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও জননিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধানগুলোকে মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ ছিল সারাবছর।


আসক জানায় জানায়, গত ১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্যালয়ে সংঘটিত পরিকল্পিত হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং এর ফলে সেখানে কর্মরত সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। 

আসকের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সদ্য গেল বছর দেশে অন্তত ৪০১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় ৪ হাজার ৭৪৪ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হন।

আসকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি চরম ও ধারাবাহিক রূপ ধারণ করেছে, যা ২০২৫ সালে আরো বিস্তৃত ও সহিংসতর হয়ে উঠেছে। 

এদিকে আসক জানায়, ২০২৫ সালে সারাদেশে কারা হেফাজতে ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।


এর মধ্যে ৬৯ জন হাজতি এবং কয়েদি ৩৮ জন। সারাদেশের কারাগার গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা গেছেন ৩৮ জন এবং এরপর রয়েছে গাজীপুরে ৭ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া বাকি মৃত্যুগুলো হয়েছে দেশের অন্যান্য কারাগার সমুহে। এর আগে ২০২৪ সালে দেশের কারাগার সমুহে ৬৫ জন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। 
মব সন্ত্রাস 

২০২৫ সালের অন্যতম গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন মব সন্ত্রাস করে গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ড। ওই সময়ে মব সন্ত্রাসে কমপক্ষে ১৯৭ জন নিহত হয়েছে। এর আগে ২০২৪ সালে মব সন্ত্রাসে নিহত হয়েছিল অন্তত ১২৮ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্যানুযায়ী, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের এই সময়কালে কমপক্ষে ২৯৩ জন নাগরিক মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হন। মব সন্ত্রাস করে নারী, পুরুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক অনেক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা, বাউল সম্প্রদায়ের মানুষসহ অনেক মানুষকে হেনস্থা করা হয়েছে, মারধর, জুতার মালা পড়ানোর ঘটনা ঘটেছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

২০২৫ সালে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও অব্যাহত ছিল। আসককের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩৮ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যার ৩৮টি ঘটনার মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, যৌথ বাহিনীর হেফাজতসহ তথাকথিত ‘গুলিতে’ বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ২৬ জন। এ ছাড়া কমপক্ষে ১২ জন ব্যক্তি দেশের বিভিন্ন থানায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। ২০২৪ সালে দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছিল ২১ জন।   

ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন

২০২৫ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ভয়ভীতি, লুটপাট, আগুন ও প্রতিমা ভাংচুরের মতো একাধিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এই বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কমপক্ষে ৪২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩টি বাড়িঘর,  অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি বসত ঘরে। এ ছাড়া চারটি মন্দিরে হামলা, ৬৪টি প্রতিমা ভাঙচুর, ৯টি জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় নিহত হয়েছে একজন, আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৫ জন। 

পারিবারিক সহিংসতা

২০২৫ সালে দেশে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ৫৬০টি। এর মধ্যে একাধিক নারী স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২৮ জন নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং ১০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বামীর পরিবারের হাতে। এ ছাড়া ২১৭  জন নারী স্বামী কর্তৃক  হত্যার শিকার হয়েছেন এবং ৬৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে স্বামীর পরিবারের সদস্যদের  দ্বারা। নিজের পরিবারের সদস্যদের হাতেও ৫১  জন নারী প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২৩  জন নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব সহিংসতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে অন্তত ১৬৮ জন নারী আত্মহত্যা করেন। 

ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি

২০২৫ সালে ধর্ষণের মোট ৭৪৯টি ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৫৬৯টি ছিল একক ধর্ষণ এবং ১৮০টি দলবদ্ধ ধর্ষণ। ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশই শিশু ও কিশোরী। ধর্ষণের পর অন্তত ৩৬  জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে, সাতজন নারী আত্মহত্যা করেছেন এবং ধর্ষণের চেষ্টার পর মৃত্যু হয় আরও ছয়জনের। পাশাপাশি ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৩০টি। একই সময়ে অন্তত ১৯৩ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। উত্যক্তকারীরা অন্তত ১৭৩জন ভুক্তভোগীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। এর মধ্যে প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে ৩ জন নারী ও ৮ জন পুরুষ। এ ছাড়া চার জন নারী আত্মহত্যা করেছে। 

যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতা ও শিশু অধিকার

উক্ত সময়ে  দেশে যৌতুকসংক্রান্ত সহিংসতার অন্তত ৭৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৫জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, ৪১ জনকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।   অন্যৗদিকে ১০২৩ জন শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একই সময়ে অন্তত ৪১০ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় প্রাণ হারায়। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণের পর হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, অপহরণ, আত্মহত্যা এবং বিস্ফোরণে মৃত্যু। 

সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন
আসকেরপ্র্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৫ সালে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কমপক্ষে ৩৪ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ২৪ জন বিএসএফের গুলিতে এবং ১০ জন বিএসএফের শারীরিক নির্যাতনের পর মারা যান। এ ছাড়াও একই সময়ে ৩৮ জন গুলিবিদ্ধ বা শারীরিকভাবে আহত হন এবং ১৪ জন অপহরণের শিকার হন, যাদের মধ্যে চার জনকে পরে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/152215