আপসহীনতার কাব্য: বেগম খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক নিঃসঙ্গ শেরপা। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সদ্য রাজনীতিতে এসে ১৯৮৩ সাল থেকে মোট তিনবার গ্রেফতার হয়ে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। তিনি গণতন্ত্রের প্রশ্নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে ভূষিত হলেন ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে । ২০০৭ এর ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও তিনি আপস করেননি। নিজের এবং সন্তানদের নিরাপদ জীবনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে গণতন্ত্রহীনতাকে মেনে নিলেন না। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি গ্রেফতার হয়ে এক বছর সাত দিন বিশেষ কারাগারে আটক ছিলেন। বিশেষ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ইন্তেকাল করেন। শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিহিংসাবসত শহীদ জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে অপমান অপদস্ত করে উচ্ছেদ করে। গুলশান কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় তার জন্য সবচেয়ে বড় আঘাতটি ছিল ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি নিজের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ। ২৭ জানুয়ারি মালয়েশিয়া থেকে আরাফাত রহমান কোকোর মৃতদেহ কার্যালয়ে এলে আন্দোলনের স্বার্থে তিনি কার্যালয় ত্যাগ করেননি । ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে বিদেশ থেকে ফিরে এসে মিথ্যা মামলা মোকাবেলা করে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জেলে চলে গেলেন। তবুও আধিপত্যবাদী রাজনীতির সাথে আপোস করলেন না। হয়ে উঠলেন ফ্যাসিস্ট শাসন বিরোধী সংগ্রামের অনন্ত প্রেরণা। আপসহীনতায় তিনি, আপসেও তিনি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এমন সব বিষয়ে আপোষ করেছেন যেটা না করলে কেবল গণতন্ত্র নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতো। ১৯৯১ সালে তাঁর পছন্দের প্রেসিডেটন্সিয়াল পদ্ধতি ছেড়ে সংসদীয় পদ্ধতিতে চলে গেলেন বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে। বিরোধী দলের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৬ সালে নির্বাচন করে অল্প কয়দিনের জন্য সংসদ অধিবেশনে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে যুক্ত করে বিরোধী দলে গিয়ে বসেন। ২০০৮ -এ একপেশে ও অসমান নির্বাচনী ক্ষেত্রের কারণে পরাজয় নিশ্চিত জেনে নির্বাচনে অংশ নেন নির্বাচনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। সকল মানুষের মতোই তিনিও হয়তো সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য চরিত্র।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি মর্যাদা প্রদান করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি মর্যাদা প্রদান কেবল একটি প্রোটোকল সিদ্ধান্ত ছিল না; বরং এটি ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভূমিকা এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অবদানের প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। একই সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণে বিশেষ সম্মান নিশ্চিত করা হয়। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়ার ‘জাতীয় অভিভাবক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি এক অনন্য রাজনৈতিক ও নৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। এই আন্দোলনের সাফল্যের পর রাষ্ট্র ও রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্নে জাতি একজন এমন ব্যক্তিত্বের দিকে তাকিয়ে ছিল, যিনি প্রতিহিংসাহীন, অভিজ্ঞ, এবং সর্বজনগ্রাহ্য সেই প্রেক্ষাপটেই বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয় অভিভাবকের আসনে অধিষ্ঠান ছিল প্রায় স্বাভাবিক ও অনিবার্য। বহু নির্যাতন, কারাবাস ও অসুস্থতার মধ্যেও তিনি কখনো প্রতিশোধের রাজনীতি বেছে নেননি। বরং তার রাজনৈতিক ভাষ্য ছিল সংযমী, সহনশীল এবং গণতান্ত্রিক। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী উত্তাল সময়ে তিনি সরাসরি ক্ষমতার দাবিতে এগিয়ে না এসে জাতিকে স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে নিতে নৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। ৭ আগস্ট ২০২৪ নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’আওয়ামী লীগ আমলে এতকিছুর পরও খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে ভালোবাসা ও শান্তির কথা বলেছেন। প্রতিহিংসা পরিহার করার কথা বলেছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এই আত্মসংযমই তাকে দলীয় নেত্রী থেকে জাতীয় অভিভাবকে রূপান্তরিত করে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন সংগ্রামের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, আর বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে রাষ্ট্রচিন্তার এক নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। সব মিলিয়ে, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান উত্তর বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয় অভিভাবকের আসন অর্জন ছিল কোনো সাংবিধানিক ঘোষণার ফল নয়, বরং জনগণের নীরব সম্মতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বীকৃতি। ইতিহাসে কিছু আসন ভোটে নয়, বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত হয়—এই আসন তেমনই এক আস্থা ও অভিভাবকত্বের প্রতীক।
বাংলাদেশের আপসহীন এই নক্ষত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৩০ডিসেম্বর সকাল ৬টার দিকে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই । বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশ আজ শোকাচ্ছন্ন। তিনি শুধু একটি দলের নেত্রী নন; তিনি ছিলেন সময়ের সাক্ষী, সংকটের নাবিক এবং প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে পথ কেটে নেওয়া এক নিঃসঙ্গ শেরপা। তাঁর জীবন ও রাজনীতি দুটোই ছিল দ্বন্দ্বের, দৃঢ়তার এবং নীরব আত্মসমর্পণের কাব্য। ক্ষমতার শীর্ষে থাকাকালীন যেমন তিনি দৃঢ় ছিলেন, ক্ষমতার বাইরে থেকেও তেমনি অবিচল। রাজনীতির রুক্ষ বাস্তবতায় মানবিকতার ছাপ রাখতে চেয়েছেন; রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর কথা বারবার স্মরণ করিয়েছেন। আজ তাঁর মৃত্যুতে প্রশ্ন রয়ে যায় এই শূন্যতা কে পূরণ করবে? উত্তর সহজ নয়। কারণ নেতৃত্ব কেবল পদ নয়; নেতৃত্ব হলো ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া। বেগম খালেদা জিয়া সেই বোঝাপড়া করেছেন সাহসে, কখনো নীরবে, কখনো সংগ্রামে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—নীতিতে আপসহীন থাকা যেমন জরুরি, তেমনি বৃহত্তর স্বার্থে সংলাপ ও সমঝোতার দরজাও খোলা রাখতে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এক গভীর ও অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করবে। তার অনুপস্থিতিতে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তা শুধু নেতৃত্বগত নয়; এটি নৈতিক কর্তৃত্ব, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতার শূন্যতা। নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু খালেদা জিয়ার মতো দীর্ঘ সময় ধরে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিনিধিত্ব করা, সংকটকালে আপসহীন অবস্থান নেওয়া এবং রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকেও গণতন্ত্রের প্রধান কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা—এটি সহজে বা দ্রুত পূরণ হওয়ার নয়। এই শূন্যতা তাই ব্যক্তির নয়, এক যুগের অবসানের প্রতিফলন—যার প্রভাব বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দীর্ঘদিন অনুভূত হবে।
সূরা আল ইমরানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তুমিই রাজত্ব দান কর যাকে ইচ্ছা, আর রাজত্ব কেড়ে নাও যাকে ইচ্ছা; তুমিই সম্মান দান কর যাকে ইচ্ছা, আর অপমানিত কর যাকে ইচ্ছা।” এই আয়াত মানব ইতিহাসের এক চিরন্তন সত্যকে তুলে ধরে ক্ষমতা, সম্মান ও পরিণতি একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাধীন। বেগম খালেদা জিয়ার জীবন ও মৃত্যু সেই সত্যেরই এক প্রতিফলন। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, নিপীড়ন ও অবহেলার অধ্যায় অতিক্রম করে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন রাষ্ট্রনায়কোচিত মর্যাদায়। রাষ্ট্রীয় শোক, সাধারণ ছুটি ঘোষণা এবং জিয়া উদ্যানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে দাফন সবই প্রমাণ করে, মানুষের দেওয়া সাময়িক অবমূল্যায়ন চূড়ান্ত নয়। আল্লাহ যাকে সম্মানিত করেন, সময়ের প্রবাহে সেই সম্মানই প্রতিষ্ঠিত হয়। তার এই সম্মানজনক বিদায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষমতা নয়, বরং ত্যাগ, ধৈর্য ও ইতিহাসে নিজের অবস্থানই মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নির্ধারণ করে। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু তাই কেবল একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়; এটি আল্লাহর ফয়সালার এক স্পষ্ট ঘোষণা সম্মান ও অপমান মানুষের হাতে নয়, রবের হাতে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য প্রেরণাস্রোত। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় আত্মমর্যাদার দর্শন জাতিকে শাসনের ভয়মুক্ত পথে এগিয়ে যেতে সাহস জুগিয়েছে। অপরদিকে খালেদা জিয়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রশ্নে দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এই আদর্শ কেবল রাজনৈতিক ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নয়; শহিদ শরীফ ওসমান হাদির মতো আত্মত্যাগী নেতাকর্মীদের রক্তে তা বহমান থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ফলে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আদর্শ যুগে যুগে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে এবং গণতন্ত্রের জন্য অবিচল থাকতে। এই চেতনাই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এক ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে। তাই, জিয়া উদ্যান হয়ে থাকবে আধিপত্যবাদী সংগ্রাম ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে।
লেখকঃ
প্রফেসর ড. সামিউল তুষার
পরিচালক (ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
এবং
পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, আরডিএ বগুড়া।
পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/152214