দেশের শিল্প বিপ্লব কোথায় আটকে আছে

দেশের শিল্প বিপ্লব কোথায় আটকে আছে

বাংলাদেশ যেন এক বিশাল তাঁতের ঘরে বোনা স্বপ্নের কাপড়। নদী, মাটি আর ঘাম মিশে তৈরি হয়েছে এক অনন্য শিল্পভিত্তিক সংস্কৃতি। কিন্তু সেই তাঁতের এক পাশে সুতো জট পাকিয়ে আছে। চাকার ঘূর্ণি চলছে তবুও কাপড় পুরোটা তৈরি হচ্ছেনা। ঠিক এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লব। চলছে কিন্তু চলছে না, এগোচ্ছে কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে না। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের মানুষকে কৃষি নির্ভর জাতি বলা হতো। কিন্তু সময় সেই চিত্র বদলে দিয়েছে। এখন মানুষ শুধু ফসল ফলায় না, তৈরি করে পোশাক, জুতা, ওষুধ, সিমেন্ট, জাহাজ সহ আরও অনেক কিছু। তবে এ যেন এক অর্ধেক বিপ্লব। যেখানে মেশিন চলে কিন্তু চিন্তার মেশিন থেমে থাকে। ফ্যাক্টরি উঠে কিন্তু উদ্ভাবনের কারখানা দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লবের গল্প অনেকটা নদীর মতো। যে নদী উৎস থেকে ছুটে আসে প্রবল গতিতে কিন্তু মোহনায় এসে বালুচরে আটকে যায়। নদী থেমে থাকে না কিন্তু গতি হারায়। বাংলাদেশের শিল্পও ঠিক তেমন, চলমান কিন্তু থমকে যাওয়া এক যাত্রা। 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ দাঁড়ায় একদম শূন্য থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, ধ্বংসস্তূপে ভরা অর্থনীতি, উৎপাদন যন্ত্র প্রায় শূন্য। সেখান থেকে মাত্র কয়েক দশকে এই দেশ তৈরি করেছে এক শক্তিশালী ভিত। বিশেষত রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পে, যা আজ দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০% জোগান দেয়। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ, ওষুধ শিল্পের বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ, জাহাজ নির্মাণ আর কৃষিজ প্রক্রিয়াজাত শিল্প, সব মিলিয়ে এক সময় মনে হয়েছিল বাংলাদেশ হয়তো নিজস্ব শিল্প বিপ্লবের পথে হাঁটছে।  কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই পথের মাঝেই কোথাও যেন এক অদৃশ্য দেয়াল। আমরা পোশাক তৈরি করতে পারি কিন্তু নিজের ডিজাইনের ব্রান্ড তৈরি করতে পারিনা। আমরা ওষুধ রপ্তানি করি কিন্তু নিজস্ব গবেষণা ল্যাবের ঘাটতি আছে। আমরা ইলেকট্রনিকস বানাতে শিখেছি কিন্তু চিপ বা উপকরণ বিদেশ থেকে আনতে হয়। অর্থাৎ, আমরা শিল্পের উৎপাদন ধাপে আছি কিন্তু উদ্ভাবন ধাপে পৌঁছাতে পারিনি। শিল্প বিপ্লব মানে শুধু কারখানা নয়, এটা একটা মানসিক, প্রযুক্তিগত এবং সাংগঠনিক পরিবর্তন। সেই জায়গাতেই বাংলাদেশের বিপ্লব থেমে আছে।  দেশের জিডিপিতে শিল্পের অংশ প্রায় ৩৫%। কিন্তু এর ৮০% আসে পোশাক শিল্প থেকে। কোভিড ১৯ এর সময় ইউরোপ-আমেরিকার বাজার বন্ধ হলে ১০০০ এর বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। এটি প্রমাণ করে আমরা কতটা এককেন্দ্রিক। আবার, শিল্প খাতে কর্মরত প্রায় ৮৫% শ্রমিকের কারিগরি প্রশিক্ষণ নেই। তারা অভিজ্ঞতায় কাজ করতে পারে কিন্তু নতুন প্রযুক্তি বা উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে আমাদের উৎপাদন দক্ষতা কমে যায়, সেই সাথে পণ্যের মানও আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছায় না। 

বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লব আটকে আছে একাধিক কারণে। তার মধ্যে রয়েছে দক্ষ মানব সম্পদের অভাব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কারিগরি বা শিল্প সংযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে শিক্ষার্থী প্রস্তুত করে। যার কারণে আমাদের কারখানা চাইলেও অভিজ্ঞ, দক্ষ প্রকৌশলী পাওয়া কঠিন। বিদেশি প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ আনতে হয়, খরচ বাড়ে। আবার, আমরা নতুন কিছু তৈরি করতে ভয় পাই। পোশাক শিল্পে এখনো বিদেশি নকশা আর ব্রান্ডের ওপর নির্ভর করি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, বন্দর, রাস্তা সব কিছুতেই অনিয়ম। কারখানাকে বিকল্প জ্বালানিতে কাজ করতে হয় যার ফলে খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য একাধিক দপ্তরে যেতে হয়, এখানকার ঘুষ প্রথা উদ্যোক্তাদের উৎসাহ কমায়। বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে যাচ্ছে, রোবোটিক্স, এআই, বিগ ডেটা ব্যবহার করছে। আর আমরা এখনও হাতে কলমে কাজ করছি। আবার, অনেক কারখানার মেশিন পুরনো। শিল্পকারখানা নদী দূষণ, বায়ু দূষণ করে, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, সরকার পরিবর্তনের সাথে শিল্পনীতি ও কর কাঠামো পরিবর্তিত হয়। যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেমে যায়। আর অধিকাংশ কারখানা ঢাকা ও চট্টগ্রামে হওয়ায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলো পিছিয়ে আছে। 

তবে, এর সমাধানের পথও রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি ও শিল্পসংযুক্ত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ইন্টার্নশিপ চালু করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু ডিগ্রি নয়, বাস্তব দক্ষতা অর্জন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে একসাথে কাজ করতে হবে আর নতুন ধারণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে সরকারের সহায়তা জরুরি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, বন্দর, সড়ক সব কিছু উন্নত করতে হবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে শিল্প বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। এছাড়া দুর্নীতি কমিয়ে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিবেশ স্বচ্ছ করতে হবে। সেই সাথে দরকার অটোমেশন, এআই ডিজিটাল ম্যানেজমেন্টে কারখানাকে রূপান্তর করা এবং সবুজ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও টেকসই উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। এছাড়া, শিল্পনীতি কর কাঠামোর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা। 

বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লব এখন এক অর্ধেক সম্পন্ন স্বপ্নের মতো। আমরা উৎপাদনে ভালো কিন্তু উদ্ভাবনে পিছিয়ে। শিল্প মানে কেবল মেশিন নয়, চিন্তার বিপ্লবও। আমাদের দরকার শুধু শ্রমিক নয়,উদ্ভাবক। শুধু কর্মচারী দরকার নয়,দরকার চিন্তা শ্রমিক। যদি আমরা শিক্ষা, প্রযুক্তি, গবেষণা, পরিবেশ, নীতি সব দিকেই সমন্বয় করি তাহলে শিল্প বিপ্লব আর আটকে থাকবে না। তখন আমরা কেবল কাপড়ই তৈরি করব না, নিজের হাতে ভবিষ্যৎ গড়বো। বাংলাদেশের শিল্প এখন সম্ভাবনার দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাদের হাতে আছে সেই চাবি যা দিয়ে দরজা খোলা সম্ভব।  

লেখক

আরমীন আমীন ঐশী

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা 

পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/151700