স্বাগতম হে বগুড়ার ছোল
দেশের রাজনৈতিক আঙিনায় নতুন খেলা চলছে। এই সমাজ-রাষ্ট্রের সংকটের গভীরতা এখন বহুদূর পর্যর্ত চলে গেছে। উত্থান হয়েছে নতুন মৌলবাদের। মব সন্ত্রাসের। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লোকালয় থেকে প্রায় দেবালয় পর্যন্ত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ইনসাফের কথা বলে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেছে। তাদের ট্যাগিং আর মব সন্ত্রাসের ভয়ে সমাজের অগ্রসর প্রতিবাদী মানুষ আজ ভীত-সন্ত্রস্ত। অথচ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্য ছিলে মানুষ প্রাণ খুলে কথা বলবে। স্বাধীভাবে চলাফেরা করবে। স্বাধীনভাবে লিখতে পারবে, সমালোচনা করতে পারবে। কিন্তু হয়েছে এর উল্টোটা। এগুলো হয়েছে দেশ কার্যত এখন রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে। মোদ্দা কথা একটি দেশ যখন তার দিকনির্দেশনা হারায়, যখন রাষ্ট্র তার অভিভাবকের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ আজ সেই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে। দেশ এখন কার্যত রাজনৈতিক অভিভাবকহীন। এই অভিভাবকহীনতা আনুষ্ঠানিক শব্দের মধ্যে দিয়ে বিচার করলে হয়তো একতরফা হবে। বিষয়টিকে দেখতে হবে বাস্তব অনুভূতির মধ্যে দিয়ে। মানুষের ঘন নি:শ্বাসের অনুভূতি মূল্যায়ন করে। রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে, প্রশাসন আছে, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। বিবৃতি দিয়ে দায় সারছে কর্র্তৃপক্ষ। রাষ্ট্র যেন কেবল একটি কাঠামো, যার ভেতরে প্রাণ নেই, বিবেক নেই। নির্বিকার সব। অথচ ধ্বংসলীলা চলছে সমানে। এই শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদ। মৌলবাদ কোরো ট্যাগিং অর্থে ব্যবহৃত শব্দ নয়। বিশ্লেষণের ধাঁচে মৌলবাদী এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক মানসিকতা, যেখানে যুক্তি অচল, সহনশীলতা দুর্বল এবং ভিন্নমত অপরাধ। মৌলবাদ যখন সমাজে শিকড় গাড়ে, তখন প্রথম আঘাতটি আসে চিন্তার ওপর। মানুষ প্রশ্ন করতে ভয় পায়, ভিন্নভাবে ভাবতে ভয় পায়, আর ভয় থেকেই জন্ম নেয় নীরবতা। এই নীরবতার ওপর ভর করেই জন্ম নেয় মব সন্ত্রাস। মব সন্ত্রাস বিচ্ছিন্ন ঘটনার আদলে দেখার সুযোগ নেই। এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার সরাসরি ফল। যেখানে আইন দুর্বল, বিচার অনিশ্চিত, আর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা অনুপস্থিত, সেখানেই মব সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিদেশে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকটি গুজব, কয়েকটি উসকানিমূলক পোস্ট, আর মুহূর্তের উত্তেজনায় একটি জনপদ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। মবের কাছে যুক্তি নেই, মানবিকতা নেই, দায় নেই, আছে শুধু সংখ্যা আর হিংসা। এই মব সন্ত্রাসের শিকার হয় গণমাধ্যম কিংবা বাক স্বাধীনতা। কারণ গণমাধ্যম প্রশ্ন তোলে, তথ্য দেয়, আয়না ধরে। আয়না ভাঙলে যেমন মুখের দাগ লুকানো যায় না। তেমনি সংবাদপত্র ধ্বংস করলে সত্য মুছে যায় না; বরং বিকৃত হয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে ফিরে আসে। অথচ আজকের বাংলাদেশে সংবাদপত্রই সবচেয়ে অনিরাপদ। স্বৈরাশসক শেখ হাসিনার গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি, গণমাধ্যম অফিসে হামলা হয়েছে, সাংবাদিকদের মারধর করা হয়েছে, মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে, প্রকাশ্য হুমকি দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হামলার আগে ঘোষণা এসেছে, তবুও রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এটি রাজনৈতিক নৈতিকতার দেউলিয়াপনা।
সাংবাদিকতা আজ হুমকির মুখে। এই হুমকি শারীরিক, মানসিক, পেশাগত এবং অস্তিত্বগত। একজন সাংবাদিক আজ কলম ধরার আগে ভাবেন, এই লেখা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? পরিবার নিরাপদ থাকবে তো? অফিস থাকবে তো? এই ভয়ের পরিবেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের নিরাপত্তাহীনতা মানে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর দুর্বলতা। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গণতন্ত্র মানে প্রশ্ন করার অধিকার, জানার অধিকার, বলার অধিকার। সংবাদপত্র এই অধিকারের বাহক। যখন সংবাদপত্র দুর্বল হয়, তখন ক্ষমতা একচেটিয়া হয়ে ওঠে, আর সেই ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ওপরই আঘাত হানে। এই বাস্তবতায় রাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বারবার বলে এসেছে, তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে। দেশের মানুষ আজ ভন্ডামি থেকে মুক্তি চায়। তারা চায় এমন রাজনীতি, যেখানে কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকবে। তারা চায় এমন নেতৃত্ব, যারা বলবে, মিডিয়াকর্মীর ওপর হামলা মানে জনগণের ওপর হামলা। যারা বলবে, মব সন্ত্রাস কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন মিডিয়াকর্মী, সাংবাদিক নেতা কিংবা বিএনপির মিডিয়া সেলের সমন্বয়ক হিসেবে আমার এই দাবি কোনো বিশেষ সুবিধার জন্য নয়। এটি পেশাগত মর্যাদার দাবি, নাগরিক অধিকারের দাবি। আমি চাই, আগামী দিনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের মান, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। এই প্রত্যাশা ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশা, যারা সত্য জানতে চায়।
বাংলাদেশে আমরা বারবার দেখেছি, হামলার পর বিবৃতি এসেছে, কিন্তু শাস্তির নজির তৈরি হয়নি। এই ব্যর্থতার জন্য শুধু প্রশাসনকে দায়ী করার সুযোগ কম। এখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতাও দায়ী। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের ঘরের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালাতে না পারে, যদি তারা স্পষ্টভাবে বলতে না পারে, এই কাজ আমাদের গ্রহণযোগ্য নয়; তাহলে মব ও উগ্র শক্তি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মব সন্ত্রাসের রাজনৈতিক ব্যবহার আজ আর গোপন কিছু নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই মব তৈরি হয় ধর্মের নামে, কোনো ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের নামে, আবার কোথাও কোথাও দলীয় আনুগত্যের ছায়ায়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই একটি বিষয় এক, এই মবের পেছনে থাকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা। দেশের মানুষ আজ এই অস্পষ্টতা থেকে মুক্তি চায়। তারা চায় এমন রাজনীতি, যেখানে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান হবে দ্ব্যর্থহীন। যেখানে সব ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় দলীয় পরিচয় কোনো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এই চাওয়াটা কোনো দলের বিপক্ষে নয়; এটি রাষ্ট্রের পক্ষে।
এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনে ছিলেন তিনি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি এখন দক্ষ রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অত্যন্ত পরিপূর্ণ। তার পরও আমি ক্ষুদ্র গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মনে করি, তারেক রহমানের সামনে এখন দুটি পথ। একটি পথ হলো, তিনি কেবল বিএনপির রাজনীতির ধারাবাহিক উত্তরাধিকার বহন করবেন। আরেকটি পথ হলো, তিনি নিজেকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন, একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। দ্বিতীয় পথটি কঠিন, কিন্তু এই পথই ইতিহাসে অমর হয়ে থাকার সুযোগ রয়েছে তার। রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার প্রথম শর্ত হলো, নিজের দলের ঊর্ধ্বে উঠে কথা বলার সাহস। সাংবাদিকতার প্রশ্নে এই সাহস সবচেয়ে জরুরি। কারণ এখানে জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত সবসময় নৈতিক সিদ্ধান্ত হয় না। কোনো কোনো সময় দলের ভেতরের শক্তিকে না বলতে হয়, মব মানসিকতাকে থামাতে হয়, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই ঝুঁকিই রাষ্ট্রকে বাঁচায়। রাজনৈতিক জীবন স্বাভাবিক অধ্যায় হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। এটি একটি বিচ্ছিন্নতা, যা একজন মানুষকে তার শিকড় থেকে দূরে নিয়ে যায়, আবার একই সঙ্গে তাকে শিকড়কে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। তারেক রহমানের নির্বাসিত জীবনকে অনেকেই দেখেছেন রাজনৈতিক বিরতি হিসেবে, কিন্তু ইতিহাস বলে, নির্বাসন অনেক সময় রাজনীতিবিদকে নতুন করে নির্মাণ করে। দূরত্ব চিন্তাকে গভীর করে, সময় অভিজ্ঞতাকে পরিণত করে, আর বিচ্ছিন্নতা আত্মসমালোচনার সুযোগ এনে দেয়। এই দীর্ঘ সময়ে তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে দেখেছেন দূর থেকে, ক্ষমতার পরিবর্তন, গণতন্ত্রের সংকোচন, মৌলবাদের উত্থান, মব সন্ত্রাসের বিস্তার, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে গণমাধ্যমের ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়া। সব কিছুর স্বাক্ষী তিনি। দেশের মানুষের তার কাছে এখন আকাশসম প্রত্যাশা। এই রূপান্তরের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে মৌলবাদের প্রশ্নে, মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কিংবা দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রশ্নে। বাংলাদেশে মৌলবাদ কখনো একক রূপে আসে না। কখনো এটি ধর্মের মোড়কে আসে, কখনো জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে, আবার কখনো সামাজিক রক্ষণশীলতার আড়ালে। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে আপস করলে কোনো নেতৃত্বই শেষ পর্যন্ত টেকসই হতে পারে না। তারেক রহমান যদি সত্যিই নিজেকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতে চান, এসব প্রশ্নে তাকে হতে হবে স্পষ্ট ও আপসহীন। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হবে, ধর্ম বা পরিচয়ের নামে সহিংসতা রাজনীতি হতে পারে না। মব সন্ত্রাস কোনো গণআন্দোলন নয়; এটি রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম। বিএনপির সবচেয়ে জনিপ্রয় নেতা তারেক রহমানের সামনে সুযোগ আছে একটি নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করার। এই ভাষায় থাকবে না হুমকি, থাকবে না প্রতিশোধের ইঙ্গিত, থাকবে না বিভাজনের সুর। থাকবে দায়িত্বের ভাষা, সংযমের ভাষা, আর সবচেয়ে বড় কথা, আস্থার ভাষা। এই আস্থা হবে দলমত নির্বিশেষ দেশের সাধারণ মানুষের, এমনকি সমালোচকদেরও।
পরিশষে বগুড়াবাসীর জন্য দারুণ চমক কদিন ধরে গণমাধ্যমের সূত্রে বিচরণ করছে যে তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষে উচ্ছ্বসিত বগুড়ার নেতাকর্মীরা। এ উপলেক্ষ সাজানো হয়েছে বগুড়া শহরের রিয়াজ কাজী লেনের গ্রিন এস্টেট বাড়ি। প্রায় ১৭ বছর পর দেশে ফিরে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়বেন বগুড়া-৬ আসন থেকে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তানকে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে বগুড়ার মানুষ। বগুড়ায় স্বাগতম আপনাকে। আপনার হাতেই মঙ্গলের আলোকবর্তিকা জ্বলে উঠুক।
লেখক:
কালাম আজাদ
সাধারণ সম্পাদক, বগুড়া প্রেসক্লাব
সমন্বয়কারী- বিএনপি মিডিয়া সেল
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ