পঞ্চগড়ের চা শিল্পে সংকট কাটিয়ে আলোর মুখ দেখছে ক্ষুদ্র চা চাষিরা, সুদিন ফিরেছে

পঞ্চগড়ের চা শিল্পে সংকট কাটিয়ে আলোর মুখ দেখছে ক্ষুদ্র চা চাষিরা, সুদিন ফিরেছে

সামসউদ্দীন চৌধুরী কালাম, পঞ্চগড় : সুদিন ফিরেছে পঞ্চগড়ের চা চাষিদের। সার সংকটের সাথে চা গাছে নতুন নতুন মড়কের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সমতলের চা চাষিরা। উৎপাদন খরচ বাড়লেও টানা কয়েক বছর কাঁচা চা পাতার দরপতনের কারণে অনেক চা চাষি উপড়ে ফেলেছিল চা বাগান।

তবে বিভিন্ন উদ্যোগে চায়ের গুণগত মানের সাথে কাঁচা চা পাতার দাম ভাল পাওয়ায় এখন আলোর মুখ দেখছেন তারা। তবে গেল মৌসুমের তুলনায় দাম ভালো মিললেও তার বড় অংশই চলে যাচ্ছে উৎপাদন খরচে। নানা সংকটের মধ্যেও এবার রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের আশা চা বোর্ডের। চায়ের উৎপাদন দুই কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতলে ২০০০ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে চা চাষে বিপ্লব ঘটে উত্তরের এই জেলায়। সেই সাথে আশপাশের জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ছড়িয়ে পড়ে চা চাষ। গড়ে ওঠে সম্ভাবনাময় দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল। বর্তমানে উৎপাদনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল এই সমতলের চা।

গত দুই যুগে পঞ্চগড়ে ছোট বড় চা বাগান গড়ে উঠেছে প্রায় ৮ হাজার। চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে ৩০টি। গেল বছরে সমতলে চায়ের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ কেজি। এবার তা দুই কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা চা বোর্ডের। পঞ্চগড়ে গত মৌসুমে সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বাজার উঠেছে ২৬ থেকে ৩১ টাকা পর্যন্ত।

পঞ্চগড়ে জেলার সমতল ভূমিতে সারি সারি চা বাগানে এখন সবুজের সমারোহ। চলছে চায়ের ভরা মৌসুম। গেলো মৌসুমে সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বাজার উঠেছে ২৬ থেকে ৩১ টাকা পর্যন্ত। কালোবাজারে চা বিক্রি বন্ধসহ কারখানাগুলোতে প্রশাসন তদারকি জোরদার করায় চা শিল্পে পরিবর্তন এসেছে বলে দাবি চা চাষিদের। নিলাম বাজারেও দর বেড়েছে পঞ্চগড়ের চায়ের। ভালো দর মেলায় চাষিদেরকেও ভালো দাম দেয়া হচ্ছে বলে জানান কারখানা মালিকরা।

তবে কারখানা মালিকদের অভিযোগ রয়েছে চা বোর্ডের প্রতি। অমরখানা মরগেন টি ইন্ডাস্ট্রিজর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ আলী চিশতি অভিযোগ করে বলেন, চা বোর্ডের দৃশ্যমান কোন পরিকল্পনা নেই। বাগানের চেয়ে কারখানার সংখ্যা বেশি হয়েছে। পাতার অভাবে কারখানা লো পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে পারছে না। ফলে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

পাতার অভাবে সপ্তাহে ৩/৪ দিন কারখানা বন্ধ  রাখতে হচ্ছে। দুই শিফটে কারখানা চালাতে কমপক্ষে ৭০ হাজার কেজি পাতার প্রয়োজন সেখানে তিনি পাতা পাচ্ছেন ২০ হাজার কেজি। কৃষকের পাতা নিয়ে মধ্যস্বত্তভোগীরা সুবিধা নিচ্ছে।

চা পাতার বাড়তি দামের আশায় চাষিরা দালালদের কাছে পাতা বিক্রি করছে। ফলে কারখানার মালিকরা অতিরিক্ত দরে দালালদের কাছ থেকে পাতা কিনছেন। ফলে চাষি এবং কারখানার মালিকদের মাঝে এসে দালালরা লাভবান হচ্ছেন। এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে না পারলে  ভবিষ্যতে এর প্রভাব নেতিবাচক হবে বলে মনে করছেন তিনি।

চা বাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মানিক খান জানান, ২০২১-২৩ আমাদের চা চাষিদের জন্য ছিল দুর্দিন। সার সংকট আর নতুন মড়কের কারণে বালাই ও কীটনাশক স্প্রে করতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেই সাথে ছিল কাঁচা চা পাতার ক্রমাগত দরপতন। ওই সময়টাতে অনেক চা চাষি তাদের চা বাগান উপড়ে ফেলে অন্য ফসল আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আমরা চা বাগান মালিক সমিতি সব মহলে গিয়েও সঠিক সমাধান পাচ্ছিলাম না।

গত বছরের পাঁচ আগস্ট পরবর্তি সময়ে নতুন জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী পঞ্চগড়ে যোগদানের পরই আশ্বাস দেন চা শিল্পের সমস্যা নিরসনে তিনি কাজ করবেন। তার উদ্যোগে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে চা শিল্প ঘুরে দাঁড়ায়। এখন চা চাষিরা তাদের কাঁচা চা পাতার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। তার অসামান্য উদ্যোগের কারণে চা চাষি সম্মেলন-২০২৫ এ জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলীকে চা বাগান মালিক সমিতির আজীবন সদস্য করা হয়।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, বিগত বছরে চা পাতার দাম না পেলেও এবার ভালো দাম পাচ্ছে চাষিরা। মানসম্মত পাতায় চা এর গুণগত মান বেড়েছে। চাহিদা বেড়েছে অকশন বাজারে। যা চাষিদের অর্জন। সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেই থাকবে এই ধারাবাহিকতা।

পঞ্চগড়ের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী বলেন, চা নিয়ে পঞ্চগড়ে যে নৈরাজ্য ছিল চাষি এবং কারখানা মালিকদের সাথে বসে সেটা নিরসন করা হয়েছে। আমরা সব বিষয়ে নজরদারি বাড়িয়েছি। বর্তমানে চাষিরা মান সম্মত পাতা সরবরাহ করায় পঞ্চগড়ের চা এর গ্রেড উন্নত হবার কারণে অকশন মার্কেটে চা এর দর বেড়েছে। সার সংকটের বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। চা চাষিরা যেন অনায়াসে সার পেতে পারে তা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।

পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/146810