যে জিয়া জনতার সে জিয়া মরে নাই

যে জিয়া জনতার সে জিয়া মরে নাই

একটা স্লোগান আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছে ‘যে জিয়া জনতার, সে জিয়া মরে নাই’। বারবার ভাবি, কেন এমন স্লোগান আজও উচ্চারিত হয়? কেন একজন মানুষ চলে যাওয়ার এত বছর পরও কোটি মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকেন? এর উত্তর খুঁজলে বারবার ফিরে আসতে হয় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের দিকে, তার আদর্শ, কর্মদক্ষতা ও ত্যাগের ইতিহাসের দিকে। জিয়ার নাম উচ্চারিত মানেই স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয়। তার জীবনটাই যেন এক অনন্ত প্রেরণার প্রতীক, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে।

জিয়াউর রহমান কেবল একজন রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক স্বপ্নবাজ সৈনিক, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, আর পরবর্তীতে রাজনীতিতে এসে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার পুরো জীবনটাই ছিল সংগ্রাম, দায়িত্ব ও দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ। তার চিন্তায় ছিল মুক্তির দর্শন, কর্মে ছিল জাতি গঠনের বাস্তব রূপরেখা। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশকে ভালোবাসা মানে জনগণের জন্য কাজ করা।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তখন তরুণ মেজর জিয়াউর রহমান দ্বিধা না করে স্বাধীনতার পক্ষে অস্ত্র ধরেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম একজন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা লাখো মানুষের অন্তরে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তোলে। সেই এক ঘোষণাই বদলে দিয়েছিল জাতির ইতিহাসের গতিপথ। জিয়াউর রহমান কণ্ঠে উচ্চারিত সেই আহ্বান আজও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে আছে। একজন সৈনিক হিসেবে জিয়াউর রহমান ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তিনি ছিলেন শৃঙ্খলাবদ্ধ, কৌশলী ও দূরদর্শী। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে তার নেতৃত্বে অসংখ্য সফল অপারেশন পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার সেই সামরিক দক্ষতা দেশ পরিচালনায়ও বড় ভূমিকা রাখে। তাঁর নেতৃত্বে সৈনিকেরা পেয়েছিল এক অদম্য মনোবল। তিনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে সংকটেও দৃঢ় থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। 

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত, তখন দায়িত্ব নেন রাষ্ট্র পরিচালনার। দেশের মানুষ তখন হতাশ, বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসী জাতি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন উন্নয়ন শুরু হয় শৃঙ্খলা থেকে। জিয়াউর রহমান ছিলেন পুনর্গঠনের স্থপতি, যিনি ধ্বংসস্তূপে থেকেও স্বপ্ন দেখেছিলেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।
জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সৎ, মিতভাষী। তিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করতেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ‘নিজের উপর বিশ্বাস রাখো’ এই নীতিতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। তার সরল জীবনযাপন ছিল রাজনীতির নৈতিকতার প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছিলেন  সততা দিয়েই নেতৃত্বের বিশ্বাস অর্জন করা যায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন ছিল জিয়ার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি বুঝেছিলেন, দেশে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি দরকার যা হবে দেশের মানুষকেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী। ১৯৭৮ সালে তিনি বিএনপি গঠন করেন, এবং অল্প সময়েই এই দলটি জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে জনগণই ছিল ক্ষমতার মূল উৎস। বিএনপি আজও সেই দর্শনের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। বিএনপির নীতি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ যেখানে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক ঐক্য মিলে এক নতুন জাতীয় পরিচয় তৈরি হয়। এই ধারণা আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে শক্তিশালী দর্শনগুলোর একটি। এই দর্শন জাতিকে দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের শক্তি। জিয়া রহমান প্রমাণ করেছিলেন বাংলাদেশ নিজের পরিচয়ে বিশ্বে টিকে থাকতে পারে।

জিয়াউর রহমান ছিলেন উন্নয়ন চিন্তার প্রবর্তক। তিনি গ্রামীণ উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতার ধারণা দেন ‘গ্রাম হবে উৎপাদনের কেন্দ্র’। যুব উন্নয়ন প্রকল্প, ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ স্লোগান সবই তার সময়ের উদ্যোগ। তিনি গ্রামীণ অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। কৃষক, শ্রমিক, তরুণ সবাইকে তিনি জাতি গঠনের অংশীদার বানান।

বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করেন কৃষি, শিল্প ও সামাজিক উন্নয়নে। তার নীতি ছিল কাজ করো, উৎপাদন বাড়াও, দেশ গড়ো। কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, শিক্ষা সব খাতে তিনি নতুন চিন্তার জন্ম দেন। তরুণ প্রজন্মের মাঝে তিনি জাগিয়েছিলেন আমি পারি মানসিকতা। তার বিশ্বাস ছিল দেশের শক্তি নিহিত আছে তরুণদের হাতে।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পথে পরিচালনা করেন। তিনি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ নীতি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশকে তিনি জাতিসংঘ, ওআইসি, সার্কসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছিলেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে। তার কূটনৈতিক দূরদর্শিতা আজও বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি।

জিয়াউর রহমান ছিলেন একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক ও সৎ ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে সরলতা বজায় রেখেছিলেন। বিলাসিতা বা ক্ষমতার অহংকার তার মধ্যে ছিল না। জনগণের মাঝে তার জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাস ছিল এই সততা ও কর্মনিষ্ঠার ফল। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ তিনি অনুভব করতেন নিজের পরিবারের মতো। তার হৃদয়ে ছিল একান্তই বাংলাদেশ। তিনি রাজনীতিতে কখনো প্রতিহিংসা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আনেননি। বরং সবাইকে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার নীতি ছিল রাজনীতি হবে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের জন্য, ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নয়। তিনি রাজনীতিকে দেখেছিলেন জনসেবার ক্ষেত্র হিসেবে, ক্ষমতার নয়। সেই কারণেই আজও তার আদর্শ রাজনীতির নৈতিক দিশারি। জিয়াউর রহমান শুধু ইতিহাসের চরিত্র নন  তিনি একটি ভাবনা, একটি দর্শন। তার নেতৃত্বে যে আত্মবিশ্বাস, যে দেশপ্রেম জেগে উঠেছিল, তা আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছে। তার চিন্তা আজও অনুপ্রেরণা জোগায় নতুন প্রজন্মকে। তিনি ছিলেন নেতৃত্বের এক জীবন্ত পাঠশালা।

তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক সময় এসেছিলেন, যখন মানুষ দিকহারা। তিনি তাদের দিক দেখিয়েছিলেন নিজের উপর বিশ্বাস রাখার, কাজ করার, দেশ গড়ার। তার প্রতিটি কাজ আজও প্রাসঙ্গিক। তার এই জনমুখী চিন্তা, সততা, উন্নয়ন দর্শন ও জাতীয়তাবোধের কারণেই আজও মানুষ বলে যে জিয়া জনতার, সে জিয়া মরে নাই। জিয়া বেঁচে আছেন প্রতিটি সংগ্রামী তরুণের স্বপ্নে। তার নামই আজ প্রেরণার অন্য নাম। আজকের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আদর্শকে জানাটা অত্যন্ত জরুরি। কেবল তার নাম ব্যবহার নয়, তার চিন্তা, নীতি, ও দেশপ্রেম অনুশীলন করতে হবে। রাজনীতি মানে ক্ষমতা নয়, রাজনীতি মানে দায়িত্ব, জনগণের সেবা ও দেশ গড়ার অঙ্গীকার। সময় এসেছে জিয়ার রাজনীতি ফিরে দেখার, তার আদর্শে নতুন প্রজন্ম গঠনের। কারণ দেশ গঠনের জন্য জিয়ার পথই সবচেয়ে বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক। আমাদের রাজনীতিতে এখন প্রয়োজন জিয়ার মতো দূরদর্শী নেতৃত্ব, যিনি দেশকে রাজনীতি ও উন্নয়নের সমান্তরাল পথে এগিয়ে নেবেন। যেমনভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা থেকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছিলেন, তেমনভাবেই আমাদেরও নিজ নিজ জায়গা থেকে সৎ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেখিয়েছিলেন নেতৃত্ব মানে ত্যাগ, সেবা ও সততা। আমাদেরও সেই পথেই হাঁটতে হবে।

আমাদের ইতিহাস, আমাদের প্রেরণার নাম জিয়াউর রহমান। তার আদর্শই আমাদের পথ দেখাবে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকবেন জনতার হৃদয়ে, কাজের মাধ্যমে, চিন্তার গভীরে। তিনি অমর কারণ তার আদর্শ অমলিন। সত্যিই “যে জিয়া জনতার, সে জিয়া মরে নাই।”

লেখক:  

ইসরাফিল আলম রাফিল 

শিক্ষার্থী

গণিত বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/146717