চার স্তম্ভ নির্ধারণ করে প্রযুক্তির ভবিষ্যত
মোঃ রেজাউল করিম রাজু : বর্তমান ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার বা যেকোনো স্মার্ট ডিভাইস আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পেশাগত কাজ থেকে শুরু করে বিনোদন কিংবা দৈনন্দিন যোগাযোগ সবকিছুই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। আর এই প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে চারটি প্রধান উপাদান: প্রসেসর, র্যান্ডম অ্যাক্সেস মেমোরি (র্যাম), মাদারবোর্ড এবং স্টোরেজ। এই চারটি হার্ডওয়্যারের সম্মিলিত পারফরম্যান্সই নির্ধারণ করে একটি ডিভাইসের ক্ষমতা ও গতি।
কম্পিউটারের মস্তিষ্ক প্রসেসর : যেকোনো কম্পিউটারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ) বা প্রসেসর। ব্যবহারকারীর দেওয়া সমস্ত নির্দেশ প্রক্রিয়াকরণ এবং ডেটা ব্যবস্থাপনা করে এই ছোট্ট চিপটি। প্রসেসরের ক্ষমতা পরিমাপ করা হয় এর ক্লক স্পিড (গিগাহার্টজ), কোর সংখ্যা এবং থ্রেডের ওপর ভিত্তি করে। বর্তমানে ডেস্কটপ প্রসেসরের বাজারে ইন্টেল ও এএমডি এই দুই কোম্পানিরই একচ্ছত্র আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইন্টেল সম্প্রতি তাদের নতুন কোর আল্ট্রা সিরিজ উন্মোচন করেছে, যার শীর্ষ মডেল ইন্টেল কোর আল্ট্রা ৯ ২৮৫কে সর্বোচ্চ ৫.৭ গিগাহার্টজ পর্যন্ত ক্লক স্পিড দিতে সক্ষম এবং এতে যুক্ত হয়েছে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা। অন্যদিকে, এএমডি বাজারে এনেছে তাদের সর্বশেষ রাইজেন ৯ ৯৯৫০এক্স৩ডি প্রসেসর, যা ১৬টি কোর ও ৩২টি থ্রেডের শক্তিশালী কাঠামো এবং উন্নত থ্রিডি ভি-ক্যাশ প্রযুক্তির মাধ্যমে মাল্টি-কোর পারফরম্যান্স ও গেমিং দক্ষতায় নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের বাজারেও এই দুটি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের প্রসেসর সহজলভ্য। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টেল কোর আই-৩ বা এএমডি রাইজেন ৩ সিরিজ যথেষ্ট হলেও, গেমিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন বা ভিডিও এডিটিংয়ের মতো ভারী কাজের জন্য কোর আই-৫, আই-৭ বা রাইজেন ৫, রাইজেন ৭ সিরিজের প্রসেসর বেশি জনপ্রিয়। নভেম্বরের বাজার দাম অনুযায়ী, রাইজেন ৫ ৫৬০০জি-এর মতো প্রসেসর প্রায় ১৪,৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, যা বাজেট গেমারদের জন্য একটি আকর্ষণীয় অপশন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : প্রসেসর প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের ওপর কেন্দ্র করে এগোচ্ছে। প্রসেসর নির্মাতারা এখন নিউরাল প্রসেসিং ইউনিট যুক্ত করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, যা এআই-ভিত্তিক কাজগুলোকে আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করবে। এছাড়া কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো যুগান্তকারী প্রযুক্তিও প্রসেসরের ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
গতির সঞ্চালক র্যাম : র্যান্ডম অ্যাক্সেস মেমোরি বা র্যাম হলো কম্পিউটারের স্বল্পমেয়াদী মেমোরি, যা চলমান প্রোগ্রাম ও ডেটা সাময়িকভাবে সংরক্ষণ করে। র্যাম যত বেশি ও দ্রুতগতির হবে, কম্পিউটার তত দ্রুত একাধিক কাজ একসাথে (মাল্টিটাস্কিং) করতে পারবে। সাম্প্রতিক অবস্থা ও ট্রেন্ড : বর্তমানে ডাবল ডেটা রেট 4 (ডিডিআর ৪) র্যাম সর্বাধিক ব্যবহৃত হলেও, প্রযুক্তিপ্রেমীদের মধ্যে (ডিডিআর ৫) র্যামের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে। (ডিডিআর ৫) র্যাম (ডিডিআর ৪)-এর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ব্যান্ডউইথ এবং উন্নত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে। এটি উচ্চ রেজোলিউশনের গেমিং এবং পেশাদার ভিডিও এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেয়।
বাংলাদেশে টুইনমস, থান্ডার জিএক্স, করসেয়ারের মতো ব্র্যান্ডের ৮ জিবি ডিডিআর ৪ র্যাম ৩,০০০ থেকে ৪,৭০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। তবে ডিডিআর ৫ প্রযুক্তি নতুন হওয়ায় এর দাম এখনো কিছুটা বেশি এবং এটি ব্যবহারের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ মাদারবোর্ড ও প্রসেসর প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : আগামীতে ডিডিআর ৬ র্যাম প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে, যা আরও বেশি গতি এবং ডেটা প্রসেসিং ক্ষমতা প্রদান করবে। এছাড়া, কম্পিউটিংয়ের ধরন পরিবর্তনের সাথে সাথে র্যামের গঠন এবং কার্যকারিতাতেও নতুনত্ব আসবে, যা ক্লাউড কম্পিউটিং এবং এজ কম্পিউটিংয়ের মতো প্রযুক্তিকে আরও শক্তিশালী করবে।
সকল যন্ত্রাংশের যোগসূত্র মাদারবোর্ড : মাদারবোর্ড হলো একটি প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড (পিসিবি), যা কম্পিউটারের প্রসেসর, র্যাম, স্টোরেজ এবং অন্যান্য সকল হার্ডওয়্যারকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে।] একে কম্পিউটারের "মেরুদণ্ড" বলা যেতে পারে, কারণ এর ওপরই পুরো সিস্টেমের স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা নির্ভর করে। সাম্প্রতিক অবস্থা ও ট্রেন্ড : মাদারবোর্ডের কার্যকারিতা এর চিপসেট, সকেট এবং কানেক্টিভিটি পোর্টের ওপর নির্ভর করে। যেমন, ইন্টেলের নতুন প্রসেসরের জন্য নির্দিষ্ট সিরিজের মাদারবোর্ড প্রয়োজন, তেমনি এএমডির জন্যও রয়েছে আলাদা প্ল্যাটফর্ম। বর্তমানে পিসিআই ৫.০ স্লটযুক্ত মাদারবোর্ডগুলো বাজারে আসতে শুরু করেছে, যা নতুন প্রজন্মের গ্রাফিক্স কার্ড এবং স্টোরেজ ডিভাইসগুলোর সর্বোচ্চ গতি নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের বাজারে আসুস, গিগাবাইট, এমএসআই এর মতো ব্র্যান্ডের মাদারবোর্ড বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি গিগাবাইট তাদের নতুন বি৮৫০আই অরোস প্রো (মিনি-আইটিএক্স) মাদারবোর্ড বাজারে এনেছে, যা ছোট আকারের শক্তিশালী পিসি তৈরির জন্য আদর্শ। এতে ওয়াইফাই ৭ এবং পি সি আই ই ৫.০ এম.২ স্লটের মতো আধুনিক সব সুবিধা রয়েছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : ভবিষ্যতে মাদারবোর্ডগুলো আরও বেশি ইন্টিগ্রেটেড এবং স্মার্ট হয়ে উঠবে। তারবিহীন সংযোগ এবং উন্নত পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম মাদারবোর্ড প্রযুক্তির প্রধান চালিকাশক্তি হবে। অন-বোর্ড এআই চিপসেট যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মাদারবোর্ড নিজেই সিস্টেমের পারফরম্যান্স অপটিমাইজ করতে সক্ষম হবে।
তথ্যের ডিজিটাল ভান্ডার : কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার এবং ব্যক্তিগত ফাইলগুলো যেখানে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে, তাকেই স্টোরেজ ডিভাইস বলা হয়। কয়েক বছর আগেও হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ ছিল প্রধান স্টোরেজ মাধ্যম, কিন্তু এখন এর জায়গা দখল করে নিয়েছে সলিড-স্টেট ড্রাইভ । সাম্প্রতিক অবস্থা ও ট্রেন্ড : এসএসডি প্রচলিত হার্ডডিস্কের চেয়ে বহুগুণ দ্রুত ডেটা পড়তে ও লিখতে পারে, যার ফলে কম্পিউটার চালু হওয়া থেকে শুরু করে যেকোনো সফটওয়্যার লোড হওয়া পর্যন্ত সবকিছুই অনেক দ্রুত হয়। বর্তমানে নন-ভোলাটাইল মেমোরি এক্সপ্রেস প্রযুক্তির এম.২ এসএসডি সবচেয়ে দ্রুতগতির স্টোরেজ হিসেবে পরিচিত। এটি সরাসরি মাদারবোর্ডের পি সি আই ই স্লটে যুক্ত হওয়ায় সাটা-ভিত্তিক এসএসডি-র তুলনায় কয়েকগুণ বেশি গতি প্রদান করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে এখন পি সি আই ই জেন ৫ এসএসডি পাওয়া যাচ্ছে, যা অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুত ডেটা ট্রান্সফার স্পিড দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের বাজারেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাটা এবং এনভিএমই এসএসডি সহজলভ্য, যা ব্যবহারকারীদের বাজেটের মধ্যে থেকেই কম্পিউটারের গতি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : স্টোরেজ প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ডিএনএ ডেটা স্টোরেজের মতো ধারণার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে এক গ্রাম ডিএনএ-তে কয়েকশ পেটাবাইট তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া, ক্লাউড স্টোরেজের জনপ্রিয়তা বাড়লেও ব্যক্তিগত কম্পিউটারে দ্রুতগতির ও নির্ভরযোগ্য লোকাল স্টোরেজের চাহিদা সব সময়ই থাকবে।
প্রসেসর, র্যাম, মাদারবোর্ড ও স্টোরেজ—এই চারটি উপাদানের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটির উন্নতি অন্যটির কার্যকারিতাকে বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের প্রযুক্তি বাজারও বৈশ্বিক ট্রেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে পেশাদার সবার কাছেই আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে যাচ্ছে। একজন সচেতন ব্যবহারকারী হিসেবে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক যন্ত্রাংশ বাছাই করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ প্রযুক্তির সঠিক সমন্বয়ই পারে আপনার ডিজিটাল জীবনকে আরও মসৃণ ও গতিময় করে তুলতে।
যোগাযোগ করুন : rajuitnews@gmail.com