খাদ্য অপচয় ক্ষুধার্তদের বঞ্চনার নামান্তর
আমাদের বেঁচে থাকার প্রাণভোমরাই হলো খাদ্য। অথচ বিষ্ময়ের বিষয় হলো-পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের প্রাচুর্য থাকলেও বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। গবেষকদের মতে-সাধারণভাবে খাবার সম্পূর্ণভাবে না খেলে হয় ফুড ওয়েস্ট বা খাদ্য অপচয় আর ফুড লস বা খাদ্য নষ্ট হলো উৎপাদন বা আহরণের পর গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছানো। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে কোন খাবার যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেটিও খাদ্য অপচয়ের আওতায় পড়বে। এর মধ্যে ফুড লস্ট হয় মাঠ পর্যায় থেকে গ্রাহকের হাতে আসা পর্যন্ত সময়ে। আর ফুড ওয়েস্ট বা অপচয় হয় গ্রাহকের হাতে আসার পর। এক গবেষণায় দেখা গেছে-দেশে যখন ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তখন প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশই নষ্ট বা অপচয় হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয় হয় বাংলাদেশে। জাতিসংঘের খাদ্যবর্জ্য সূচক প্রতিবেদন, ২০২৪ অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ৫০ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়, যা তিন বছর আগের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। বছরে জনপ্রতি অপচয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কেজি, যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের চেয়েও বেশি। অথচ এ অপচয় রোধ করা গেলে বাংলাদেশের মানুষকে অনায়াসে চার মাস পর্যন্ত খাওয়ানো সম্ভব।
খাদ্য অপচয়ের চেয়ে খাদ্য নষ্ট হওয়ার হার অনেক বেশি। যত খাদ্য নষ্ট হয় তার ৮৭ শতাংশই ঘটে উৎপাদন, মজুত প্রক্রিয়া ও বিপণন পর্যায়ে। লক্ষ্য করা গেছে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে খাদ্যপণ্যের বেশিরভাগ অপচয় ঘটে ফসল কাটা, সংরক্ষণ ও পরিবহনের সময়; অন্যদিকে শহরাঞ্চলে বেশি অপচয় হয় বাসাবড়ি, সচ্ছল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ও রেস্তোরাঁগুলোতে। অপচয়ের ৬১ শতাংশই হয় বাড়িতে, ২৬ শতাংশ রেস্তোরাঁ, আর বাকি খাবার হাট-বাজারে। গবেষকরা বলছেন-বাড়ি ও রেস্তোরাঁয় খাবার অপচয়ের মূল কারণ হলো-দরকারের চেয়ে বেশি রান্না করা, অতিরিক্ত খাবার কিনে তা ব্যবহার না করা এবং খাবার সংরক্ষণ যথাযথভাবে না করা। শহরাঞ্চলের বিয়েতে, কমিউনিটি সেন্টারে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় হয়। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমরা অনেকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার প্লেটে নিই। কিন্তু সবটা খেতে পারি না। পাশে বসা ছোট বাচ্চার প্লেটেও স্তুপ করে খাবার তুলে দিই। বুফে হলে খাবার নিতে নিতে পিরামিড বানিয়ে ফেলি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে যে পরিমাণ খাদ্য ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়, তার তিন ভাগের এক ভাগ খাবার দিয়ে ৮৭ কোটি ক্ষুধার্তের খুব ভালোভাবেই ক্ষুধা মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের প্রধান বলেছেন-সম্পদের স্বল্পতা নয়, খাদ্যের অপচয়ই বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার প্রধান কারণ। এ অপচয় কেবল খাবারের অপচয় নয়, খাদ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সম্পদেরও অপচয়। অর্থাৎ যে ফসল ফলাতে কৃষকের কঠোর পরিশ্রম হয়; পানি, বীজ, সার ও বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার হয়, সেই খাবার যখন ডাস্টবিনে যায়, তখন সেসব মূল্যবান সম্পদেরও একই সঙ্গে অপচয় হয়। খাদ্য অপচয় কেবল মানবিক নয়, পরিবেশগত বিপর্যয়েরও এক বড় উৎস। জৈব খাদ্যবর্জ্য ভাগাড়ে পচে মিথেন গ্যাস তৈরি করে, যা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। খাদ্য অপচয়ের এই যে ভয়াবহ অবস্থা তা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন-বাড়িতেই বেশি খাবার নষ্ট হয় বলে আমাদের অভ্যাসের কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যেমন-পরিমিত খাবার তৈরি করা, ফ্রিজে সঠিক উপায়ে ও সঠিক তাপমাত্রায় খাবার সংরক্ষণ করা, অতিরিক্ত খাবার ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে ক্ষুধার্তদের দান করে দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া খাদ্য অপচয় রোধ করার একটি সাধারণ উপায় হলো খাদ্যের সম্পূর্ণটা খাওয়া। যেমন ফুলকপির মতো সবজিতে পুরোপুরি ভোজ্যপাতা থাকলেও আমরা সাধারণত ফুলের অংশটিকেই খেয়ে থাকি, বাকিটুকু ফেলে দিই, যার পুষ্টিগুণের কারণে পুরোটাই খাওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে-উৎপাদন পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাজারে, রেস্তোরাঁ ও কমিউনিটি সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি নজরদারি বা মনিটরিং ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে খাদ্য অপচয় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। বিষ্ময়ের ব্যাপার হলো-বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় বিষয়টি দেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এক সংবাদপত্রে বলেছেন-ভোক্তা পর্যায়ে কেউ নষ্ট বা মানোত্তীর্ণ খাবার দিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু কেউ খাদ্য নষ্ট বা অপচয় করলে আমাদের কিছু করার নেই। অথচ খাদ্য অপচয় রোধ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মতো খাদ্য অপচয় রোধ কর্তৃপক্ষ গঠনও তাই জরুরি। খাদ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে অপচয় রোধ করা গেলে সেই বেঁচে যাওয়া খাবার অনেক ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির কাজে লাগতে পারে, যা তাদের অধিকারও। যাচ্ছেতাই ভাবে খাদ্য অপচয় করা মানে বিপুল সংখ্যক ক্ষুধার্তের মুখের খাবার কেড়ে নেয়া। এটা রোধ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। একইসাথে ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো ও অপচয় রোধ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজকেও।
লেখক:
রাহমান ওয়াহিদ
কবি, কথাশিল্পী ও কলামিষ্ট ।
পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/146366