নারীর কাঁধে ঋণের বোঝা, সুফল ভোগে অবহেলা !

নারীর কাঁধে ঋণের বোঝা, সুফল ভোগে অবহেলা !

সংসারের প্রধান পুরুষ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। নারীদের কাগুজে সম্মান দেওয়া হলেও তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ পারিবারিকভাবে উপেক্ষিত। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কিংবা পারস্পরিক আলোচনায় আবার নারীদের অংশ কেবলই অর্থযোগানের সহায়ক হিসাবে।

বগুড়ার মতো আঞ্চলিক শহরে বেসরকারী ঋণদানকারী এনজিও বিস্তৃত পরিসরে কাজ করে থাকে। সংস্থাগুলো সামাজিক অর্থনৈতিক বিস্তৃতিতে ব্যাপক ভূমির রাখছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান গ্রাহক/সদস্য নারী। সদস্যদের হিসাবের বিপরীতে তারা ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে থাকে। ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে ক্ষুদ্রঋণের প্রায় শতভাগ  গ্রাহক/ সদস্যই নারী। ক্ষুদ্র ব্যবসা, গবাদি পশুপালন কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে ঋণ গ্রহণ করেন নারীরা।

কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের চারপাশের সেই স্বপ্নবাজ নারীদের ঋণের পেছনে  বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে সাংঘারিক আর্থিক পিছুটানের হাজারও গল্প। আর্থিক সংকট বা সমস্যা সমাধানে পুরুষ প্রধান পরিবার ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবারে নারীদের কাঁধে তুলে দিচ্ছে ঋণের বোঝা। ধূলিচাপা পড়ছে নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন।

আবার, অনেক নারীসদস্য তাদের ঋণের টাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে তুলছে ঠিকই কিন্তু ব্যবসালব্ধ অর্থ ব্যবহারের স্বাধীনতা তার হাতে নেই। শীতকালে বগুড়া সহ উত্তরাঞ্চলে শীত জেঁকে বসে। গড়ে ওঠে রাস্তার পাশে পিঠা-পুলি, গরম পোশাকের নানা অনুসঙ্গের ক্ষুদ্র ব্যবসা। বাস্তবতায় দেখা যায় এসব মৌসুমী নানা ক্ষুদ্র ব্যবসা বছরব্যাপী চলমান থাকে। সচল রাখে সংসারের অর্থনীতির গাড়ী। কিন্তু, সংসারের সেই সচল অর্থযোগানের জ্বালানি হয়ে নারী পায়না কোন  সফলতার সুখ। তিনি কেবলই হয়ে থাকেন মমতাময়ী মা, বোন, কিংবা অনুগত স্ত্রী।  অবশ্য নারীর কাঁধে ঋণের বোঝা চাপানোর জন্য কেবলই পুরুষই দায়ী নয়। এটা ঋাদাতা প্রতিষ্ঠান গুলোর একটি নতুন অর্থনৈতিক ফাঁদ। স্বপ্ন যুঋেণ প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নারীকে প্রধান ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। কারণ হিসাবে বলা হয়-পুরুষদের তুলনায় নারীরা ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেন।

বেসরকারী এনজিও ব্র্যাকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ প্রকার না করার শর্তে বলেন - নারীরা আমাদের প্রদানকৃত ঋণ সঠিক সময়ে ফেরত দিতে সচেতন থাকেন। কোন কারণে সময় লাগলে আগে জানান এমনকি তাদের পুরুষ (স্বামী/ছেলে/জামাই) দের চাপ দিয়ে ঋণ পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করেন। আবার, আমরা আমাদের অনেক নারী সদস্যদের নিকট থেকে পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সুবিধা (ঋণ) নেওয়ার জন্য শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও পাই । নারীদের আর্থিক চাপ শতভাগ থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মূল্যায়ন আজও উপেক্ষিত। 

অবশ্য নারীর কাঁধে ঋণের বোঝা চাপানোর জন্য কেবলই পুরুষই দায়ী নয়। এটা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান গুলোর একটি নতুন অর্থনৈতিক ফাঁদ। ক্ষূদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নারীকে প্রধান ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। কারণ হিসাবে বলা হয়-পুরুষদের তুলনায় নারীরা ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেন।
                                                                                                         
মানসিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকেই কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠাগুলো। ফলে প্রকৃত অর্থে নারীরা জ্বাবলম্বীতা নয় বরং নিয়রি কিস্তি আদায়ের নিশ্চয়তাই হয়ে উঠেছে এনজিওগুলে প্রধান লক্ষ্য- এমন মনে করছেন বিশ্বেষজ্ঞরা।সরকারি আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের  সহকারি অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সরকার বলেন- আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন এখনও উপেক্ষিত।নারীরা ক্ষূদ্রঋণ নিয়ে সংসারের বিভিন্নকাজে ঠিকউ দেন, ক্ষেত্র বিশেষে কায়িকশ্রমও করে সহায়তা করেন কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা উপভোগ করেন না । 

তিনি আরও বলেন- নারীদের   অর্থনৈতিক মুক্তি আনায়নে তারা বিভিন্ন শারিরিক,মানসিক পরিশ্রম করলেও তারা পরিবারে উপেক্ষিত। আর্থ-সামাজিক মাপকাঠিতে সমাজের নিম্ন-ম্নিমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সকল স্তরেই একই চিত্র। দরিদ্রসীমার নিচে যাদের অবস্থান কিংবা নিম্নবিত্ত তারা অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনেরও স্বীকার হয় , তাদের বাধ্য করা হয় ঋণগ্রহণে এবং তাদের ওপর সেই গৃহীত ঋণ পরিশোধেও বাধ্য করা হয়। 

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরেটির মতে বগুড়া অঞ্চলে ক্ষূদ্র ঋণের চিত্র:
ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের তথ্য বিশ্লেষণে বিভাগীয় পর্যায়ের তথ্য উস্থাপন করা হলেও, Microfinance in Bangladesh ২০২৩ সংস্করণে দ্বিতীয়বারের মত জুন ২০২৩ স্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের প্রকৃত তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় নিচের টেবিল ২.৬ এ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের জেলাভিত্তিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। উক্ত তথ্যে জেলা পর্যায়ের দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মৌলিক তথ্য যেমন: শাখা সংখ্যা, সদস্য সংখ্যা, ঋণগ্রহীতা সংখ্যা, ঋণস্থিতি এবং সঞ্চয়স্থিতির পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ্যের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতে জেলার শতকরা হারও উল্লেখ করা হয়েছে। 

বর্ণিত জেলা পর্যায়ের উক্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের বিভাগ অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বিস্তৃতি ও প্রসার বিবেচনায়  নিম্নোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে আরো লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী বগুড়া জেলায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বিস্তৃতিও অনেক বেশি। কুড়িগ্রাম জেলায় ৭২২ টি (২.৮৫%) শাখার মাধ্যমে ১,২৫৫,৬৩৪ (৩.০৭%) জন সদস্য যার মধ্যে ১,০৩০,৪৬১ (৩.২৭%) ঋণগ্রহীতা রয়েছেন। ঋণস্থিতির ২.৮৭% এবং সঞ্চয়স্থিতির ২.৬৭% এই জেলাটি ধারণ করছে। 

বগুড়া অঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার সংখ্যা। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের অলিগলি পর্যন্ত এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম। অন্যান্য সরকারি বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। সবমিলিয়ে সিলেটে ছোট, মাঝারি, বৃহৎ ও অতি বৃহৎ ক্যাটাগরির ঋণগ্রহীতা এখন প্রায় সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি। এছাড়াও রয়েছে অনিবন্ধিত স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের গ্রাহক। সেখানেও নেওয়া হয় নারীদের নামেই বিভিন্ন অংকের ঋণ। 

এই বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি নারী। ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, ক্ষুদ্র ঋণের ৯৯ শতাংশ গ্রাহকই নারী। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা, গবাদি পশুপালন কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে ঋণ নিয়েছেন।

নারীরা আবার স্বাবলম্বীও হচ্ছেন। দুই সন্তানের জননী ‘হালিমা’ (ছদ্মনাম)। স্বামী নিগৃহীতা। বয়সের মাপকাঠিতে হেরে গিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি। বেসরকারি স্কুলে করেন আয়ার কাজ। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ঋণের টাকায় । কিস্তি পরিশোধ করেন দর্জির কাজ আর চাকুরির বেতনে। ছোট ছেলেকে বড় করছেন। ছেলের উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনার খরচ সহ মা-ছেলের দিনাতিপাত বেশ স্বচ্ছলতার সাথেই যাচ্ছে। প্রয়োজনে সুচিকিৎসা পেতেও কারোর কাছে হাত পাততে হয় না। 


পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আরও অনেক সামাজিক সমস্যার মতো নারীর ক্ষমতায়ন বিংশ শতাব্দীর আজকের বাংলাদেশে উপেক্ষিত থাকলেও নারীর কাজ করার মানসিকতা আমাদের আশা দেখায়। ঋণের অসীম চাপ যেমন আমাদের নারীদের বইতে হয়, সাংসারিক কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও তারা কেবলই স্বামী-সংসার-সন্তানদের আনুগত্য আদায় করে সাংসারিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। শত কষ্ট করে পরিশোধ করেন ঋণের টাকা ,আমৃত্যু খুঁজে ফেরেন অর্থনৈতিক মুক্তি, সম্মান আর স্বাধীনতা। 

লেখক : সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক 
০১৭১১-০৩৯২৭৬

পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/145800