ওষুধ শিল্প গৌরব নাকি ভেজালের আতঙ্ক

ওষুধ শিল্প গৌরব নাকি ভেজালের আতঙ্ক

বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক। এদেশীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো দেশের ৯০% এরও বেশি ঔষধ তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আজ আমাদের ঔষধ শিল্প রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর সুনাম কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে। দুষ্প্রাপ্য এন্টিবায়োটিক, করোনার ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঔষধ আমাদের দেশের মাটিতে তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং গর্বের বিষয় বটে। কিন্তু এই গর্বের পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক বাস্তবতা - ভেজাল ঔষধ, মানহীন উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা। যে ঔষধ সেবন করা হয় কারো প্রাণ বাঁচানোর জন্য, সে ঔষধ- ই যদি প্রাণনাশের কারণ হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প আদৌ কি গৌরব নাকি আতঙ্কের আরেক নাম? একজন মা তার আদরের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালের দরজায় কড়া নাড়ছেন। হাসপাতালের খরচ কোনভাবে কুলিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশাল লম্বা ঔষধ এর লিস্ট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। মা খুব স্বভাবতই তার সন্তানকে বাঁচানোর আশায় যে কোন মূল্যে সেই ঔষধের টাকা জোগাড় করে আশার বুনিয়াদ করে সেই নির্ধারিত ঔষধ ক্রয় করে তার সন্তানের মুখে তুলে দেন। সেই ঔষধ যদি ভেজাল ঔষধ হয় , সেই মা কি নিজের অজান্তেই তার সন্তানকে হত্যার দিকে দু’পা বাড়িয়ে দিলো? শুনতেই কেমন গায়ে শিহরণ জেগে উঠছে।
 
এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে বাংলাদেশের অলিগলিতে, শহরে বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে তথা সমগ্র বাংলাদেশে। ভেজাল মানহীন ঔষধ সেবনে মৃত্যু এ ধরনের খবর আমরা নিত্যদিন খবরের পাতা উল্টালেই দেখতে পাই। সম্প্রতি খুলনায় লাজ ফার্মাকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে জাল ওষুধ বিক্রির জন্য। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ডিবি পুলিশ ভেজাল ইনজেকশন তৈরির একটি চক্র ধরেছে, যেখানে জীবন বাঁচানো ওষুধকেই নকল করে বিক্রি করা হচ্ছিল। এটা কি তাহলে গৌরবের প্রতীক? না মৃত্যুর ব্যবসা? একটা শিশুর মৃত্যু ঘটল ভেজাল সিরাপ খেয়ে কিন্তু বিচার হলো কই? বেনাপোল বন্দর থেকে ২ কোটি টাকার নিষিদ্ধ ওষুধ বাজেয়াপ্ত হলো কিন্তু এসব বাজারে ঢুকছে কিভাবে? ফার্মেসি থেকে যে ওষুধ আমরা কিনছি, তা যদি মৃত্যুর টিকিট হয়, তবে রাষ্ট্রের গর্ব আর গৌরব জনগণকে বাঁচাবে কীভাবে? 

দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ক্যান্সারের ওষুধ থেকে শুরু করে সাধারণ এন্টিবায়োটিক সবই দেশে তৈরি হচ্ছে। বাজেটে কাঁচামালের উপর কর-ছাড় দিয়ে বলা হচ্ছে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম কমানো হবে। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু মাঠের বাস্তবতা কী? বাস্তবে দেখা যায় অধিকাংশ রোগী মারা যায় বিনা ঔষধে। দিন আনে দিন খাওয়া লোকজন সরকারি হাসপাতালে যায় স্বল্প মূল্যে ভালো চিকিৎসার জন্য। কিন্তু দিন শেষে তাদের ফ্লোরে বিনা ঔষধে, বিনা চিকিৎসায় কাতরাতে কাতরাতে মরতে দেখা যায়। পাওয়া যায় না জরুরি সেবা, সরকারি নির্ধারিত ঔষধ, পাওয়া গেলেও সেটির পেছনে জড়িয়ে থাকে অন্য আরেক সিন্ডিকেট। নতুন বাজেটে ওষুধে ভ্যাট বাড়ানোয় সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। সরকার আবার বলছে জরুরি ওষুধের তালিকা সংশোধন করবে, কর ছাড় দেবে কিন্তু এই সুবিধার প্রতিফলন বাজারে আসছে না। ওষুধের দাম বাড়ছে, গরিব মানুষ চিকিৎসা ছাড়াই বাঁচার চেষ্টা করছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অধিকাংশ মানুষকে বিনা চিকিৎসায় কিংবা ভেজাল ঔষধ সেবনে মরতে হবে। রাষ্ট্র কি এই হত্যার দায় এড়াতে পারবে? ঔষধ আসলে ব্যবসা পণ্য নয়, জীবন বাঁচানোর অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা উচিত ছিল। কিন্তু সেই অস্ত্র আজ ভেজালের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আমাদের পেছন থেকে ঘায়েল করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যে দায়সারা ভূমিকা রাখছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মান পরীক্ষার স্বচ্ছতা নেই, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, আর জনগণ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাজার থেকে ওষুধ কিনে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। গরিব মানুষ চিকিৎসার খরচ সামলাতে না পেরে দিন দিন ওষুধ ছাড়া বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।  

এভাবেই কি চলতে থাকবে?  এর সমাধানে সর্বপ্রথম জাগ্রত করতে হবে নিজের বিবেককে। একটা প্রাণরক্ষাকারী ঔষধে যে বা যারা ভেজাল মিশাতে দ্বিধাবোধ করে না তারা নিঃসন্দেহে বিবেকবর্জিত মানুষ। ভেজাল ওষুধ কেলেঙ্কারিতে সর্বোচ্চ থেকে সর্বোচ্চতর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত কার্যকর করতে হবে। আর নয় জীবন নিয়ে ছেলেখেলা। ঔষধের মান ও গুনাগুন পরীক্ষার জন্য অত্যাধুনিক ল্যাব টেস্ট নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে আরো স্বয়ংক্রিয় এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি আনয়ন করতে হবে। জনগণের আস্থা ফিরে আনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে। শুধু বিদেশে ঔষধ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা নয়, দেশের সর্বস্তরের জনগণ যাতে ভেজালমুক্ত ঔষধ সেবন করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে এবং কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। জনগণকে ভেজাল চেনার উপায় ও যাচাই এর ব্যবস্থা সম্পর্কে জানাতে হবে। সচেতন করতে হবে। ভেজালমুক্ত, সাশ্রয়ী ও মানবিক ঔষধ নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঔষধকে ব্যবসা পণ্য নয়, জীবনরক্ষাকারী অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে গণ্য করতে হবে। শুধুমাত্র স্লোগানে নয়, বাস্তবেও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এই নিরব মৃত্যুর মিছিল থামবে। 

লেখক : জোবায়েদা ইসলাম জয়া 

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

jobaydajoya25@gmail.com

 

 

পোস্ট লিংক : https://karatoa.com.bd/article/145749